এই গ্যালারিতে বসেই খেলা দেখার আয়োজন হয়েছিল।
শনিবার খেলা দেখতে যাওয়া হয়নি। রবিবার সাত তাড়াতাড়ি তাই বাবার সঙ্গে দু’কিলোমিটার পথ পেরিয়ে মাকড়কেন্দি গ্রামে ফুটবল টুর্নামেন্ট দেখতে গিয়েছিল প্রসেনজিত্। কিন্তু মানবাজার থানার কাশিডি গ্রামের সেই ছেলের আর বাড়ি ফেরা হল না। খেলার মাঠেতেই ভাঙা গ্যালারির বাঁশের স্তূপের নীচ থেকে টেনে বের করা হল তার দেহ।
ঘণ্টাখানেক পরে মানবাজার হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রসেনজিতের বাবা রোহিণী মাহাতো। ভিতরে তখন ছেলের নিথর দেহ। বিড়বিড় করে বলছিলেন, “ছেলেটা বড় ফুটবল ভালবাসত। সেটাই কাল হল! ওকে না নিয়ে কী করে বাড়ি ফিরব?” পড়শিরা জানান, পেশায় কৃষক রোহিণীবাবুর দুই ছেলের মধ্যে প্রসেনজিত্ ছোট। গ্যালারির ঠিক ডানপাশেই ছেলেকে নিয়ে বসেছিলেন রোহিণীবাবু। সেই দিকেই ভেঙে পড়ে গ্যালারি। হুড়মুড়িয়ে মাথার উপরে বাঁশের খুঁটি, কাঠের টুকরো ভেঙে পড়তেই ছেলের কাছ থেকে কিছুটা দূরে ছিটকে গিয়েছিলেন তিনি। খানিক পরে তিনি সেখানে ফিরে গিয়ে দেখেন ছেলে নেই। তাঁরা যেখানে বসেছিলেন, সেখানে শুধু বাঁশের স্তূপ। ততক্ষণে মাঠের অন্য দর্শকেরা গ্যালারির নীচে চাপা পড়া লোকজনকে উদ্ধারে নেমে পড়েছিলেন। পাগলের মতো ছেলেকে খুঁজে বের করতে রোহিণীবাবুও তাঁদের সঙ্গেই বাঁশ সরিয়ে আঁতিপাঁতি করে খোঁজাখুঁজি করছিলেন। হঠাত্ দেখেন, প্রসেনজিতকে। সারা গা রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। গা হাত দিয়ে দেখেন দেহে প্রাণ নেই। সেই খবর ছড়িয়ে পড়তেই প্রসেনজিতের গ্রাম কাশিডিতে শোকের ছায়া নেমে আসে।
ততক্ষণে চারপাশ আহতদের কান্না-চিত্কারে ভরে উঠেছে। মাঠ থেকে বের হওয়ার জন্য দর্শকদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। অনেকে পড়ে গিয়ে চোট পান। অনেকে তখনও গ্যালারির বাঁশে চাপা পড়ে ছিলেন। মাঠের মধ্যে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে অনেক লোক মারা গিয়েছে। খেপে উঠে কিছু দর্শক কর্মকর্তাদের দিকে তেড়ে যান। ক্যাম্প অফিসে তাঁরা আগুন লাগিয়ে দেন। আগুন ছড়ায় গ্যালারিতেও। কর্মকর্তাদের ধরে মারধরও শুরু হয়। দর্শকদেরই কয়েকজন আহতদের উদ্ধার করে মানবাজার হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। উদ্ধারে নামেন উপস্থিত থাকা কিছু সিভিক ভলান্টিয়ারও।
মানবাজার সদর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরের এই ঘটনার কথা শুনে পুলিশ আসে। তারা পরিস্থিতি সামাল দেয়। এ দিন দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, গ্যালারি ও কমিটির অফিস থেকে তখনও ধোঁয়া বের হচ্ছিল। দমকল কর্মীরা এসে জল ছিটিয়ে আগুন নেভায়। দুপুর তিনটে নাগাদ ঘটনাস্থলে বাহিনী নিয়ে আসেন ডিএসপি (ডিএনটি) কুন্তল বন্দ্যোপাধ্যায়।
শনিবার নিরাপদে খেলা চললেও রবিবার গ্যালারি ভেঙে পড়ে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় উদ্যোক্তাদের অফিস।
মানভূম খেড়িয়া কল্যাণ সমিতি ‘অলকা শবর’ ফুটবল টুর্নামেন্ট নামে গত চার বছর ধরে এই প্রতিয়োগিতার আয়োজন করে আসছে। এ বারই তারা বড়মাপের আয়োজন করেছিল। কলকাতা, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, বিহার থেকেও দল এসেছিল। নাইজেরিয়ান কয়েকজন যুবকের খেলা দেখা নিয়েও আগ্রহ ছিল এলাকায়। প্রায় ২০০ ফুট দীর্ঘ, ১০০ ফুট চওড়া এবং ৫০ ফুট উঁচু গ্যালারিটি বাঁশ ও কাঠ দিয়ে ক্লাবের সদস্যরাই তৈরি করেন। গ্যালারির আসনের মূল্য ৫০ টাকা। সামনে চেয়ারে বসার জন্য ১০০ টাকার টিকিট ছিল। মাঠের বাকি অংশে অবশ্য টিকি ছিল না। খেলার প্রথম দিন শনিবার থেকেই গ্যালারি ভরে গিয়েছিল। সংস্থার সম্পাদক পরশুরাম মাহাতো শনিবার বলেছিলেন, “গ্যালারি ঠিকঠাক রাখতে মাঝেমধ্যেই মেরামতি করা হবে।” এ দিন ঘটনার পরে তিনি বলেন, “এ বার এমনটা ঘটবে ভাবতে পারিনি।”
মানবাজার গ্রামীন হাসপাতালে পা ভেঙে ভর্তি স্থানীয় শ্যামপুর গ্রামের বাসিন্দা রঞ্জিত মাহাতো। তিনি বলেন, “হঠাত্ পুরো গ্যালারি দুলতে শুরু করে। তারপরেই মড়মড় করে ডানদিক থেকে পুরো গ্যালারিটা ভেঙে পড়ল। ছিটকে কোথায় পড়লাম মনে নেই। জ্ঞান হারাই।” গ্যালারিতে বসেছিলেন বামনি গ্রামের বিধান মাহাতো। তিনি বলেন, “কী করে কী ঘটল বুঝতে পারিনি। হঠাত্ দেখি পুরো গ্যালারিটা সশব্দে নীচে আছড়ে পড়ল। আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম। পরে শুনি দর্শকরাই আমাকে টেনে বের করেছেন। আমার ডান পা ভেঙেছে।” মানবাজারের ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক অরুণাভ ঘোষ জানান, আহতদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা গুরুতর। তাঁদের পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। সদর হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন হুড়ার জবররা গ্রামের নির্মল সিং লারা। তিনি বলেন, “গ্রাম থেকে অনেকে খেলা দেখতে গাড়ি ভাড়া করে মাঠে গিয়েছিলাম। শরীর একটু খারাপ থাকায় টিকিট কেটে গ্যালারিতে বসেছিলাম। সেখানে ঠাসা ভিড় ছিল। হঠাত্ দেখি চারপাশ দুলে উঠল। আমি নীচে পড়ে গেলাম।” তাঁর একটি হাত ভেঙেছে। তাঁর সঙ্গীরা অবশ্য অক্ষত। তাঁরাই নির্মলবাবুকে পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে নিয়ে যান।
মাঠে যান মানবাজারের বিডিও সায়ক দেব। তিনি বলেন, “টিকিট কেটে খেলা দেখানো হলেও ওরা প্রশাসনিক অনুমতি না নিয়ে নিয়ম ভেঙেছেন। এ নিয়ে বিশদে খোঁজ নিচ্ছি।” যদিও ওই সমিতির সদস্য অজিত শবরের দাবি, “টিকিট কাটার কথা থাকলেও মাঠে বিদেশি খেলোয়াড় দেখার আশায় বিনা টিকিটে অনেকে চড়েছিলেন। অতিরিক্ত ভার সইতে না পেরে গ্যালারি ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটেছে” দর্শকদের একাংশ অবশ্য দুর্ঘটনার জন্য উদ্যোক্তাদেরই দায়ী করছেন। তাঁদের দাবি, দুর্ঘটনা না ঘটলে বাঁশের এই গ্যালারি হয়তো এলাকায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকত। কিন্তু গ্যালারি শক্তপোক্ত করতে যে ধরনের দক্ষতা দরকার তা তো সমিতির সদস্য যাঁরা গ্যালারি তৈরি করেছেন, তাঁদের নেই। তা ছাড়া গ্যালারিতে লোক তোলা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার ছিল। তা হলে প্রসেনজিতের মতো একটা ছোট ছেলেকে প্রাণ হারাতে হতো না।” তবে সমিতির সদস্যেরা বলছেন, “এলাকায় উন্নতমানের খেলা দেখিয়ে ফুটবলে উত্সাহ জোগাতেই এই আয়োজন। এখন দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে অনেকে নানা প্রশ্ন করছেন। কিন্তু দুর্ঘটনা না ঘটলে সবাই তখন বাহবাই দিতেন।” সমিতির সম্পাদক পরশুরাম মাহাতো বলেন, “একটা দুর্ঘটনাই আমাদের শেষ করে দিল।”
উদ্যোক্তারা জানান, দুর্ঘটনার পরেই কিছু দর্শক চেয়ার-টেবিল, মাইক্রোফোন-সহ নানা জিনিসপত্র মাঠ থেকে লুঠ করে নিয়ে যায়। আবার অনেকে এই দুর্ঘটনার পিছনে অর্ন্তঘাতের আশঙ্কাও করছেন। জেলা পুলিশের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, সব দিকই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy