চার্জশিট-কাণ্ডের কথা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ্যে আসতেই রাজ্যজুড়ে হৈচৈ শুরু হয়েছে। যদিও যিনি এই বিতর্কের কেন্দ্রে, সেই লাভপুরের তৃণমূলের বিধায়ক মনিরুল ইসলামকে দিনভর দেখা গেল না বোলপুর এলাকায়।
বৃহস্পতিবার সকালেই বোলপুরের জাম্বুনি মাদ্রাসা পাড়ায় তাঁর দোতলা বাড়ি সামনে গিয়ে দেখা গেল, বিধায়কের পরিচিত বড় গাড়িটি সেখানে নেই। মনিরুলের খোঁজ করতেই বাড়ির ভিতর থেকে পরিবারের সদস্যেরা জানিয়ে দিলেন, বিধায়ক এখন বাড়িতে নেই। তিনি কোথায় গিয়েছেন, তা নিয়ে অবশ্য তাঁরা মুখে কুলুপ এঁটেছেন। প্রসঙ্গত, পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মঙ্গলবারই পুলিশ বোলপুর এসিজেএম আদালতে লাভপুরে তিন সিপিএম সমর্থক ভাইয়ের খুনের ঘটনায় চার্জশিট জমা করেছে। কিন্তু সেখানে নাম নেই মূল অভিযুক্ত লাভপুরের তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলামেরই। বুধবারই এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিহতদের পরিবারের সদস্যেরা।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, দীর্ঘদিন ধরে সংলগ্ন ময়ূরাক্ষী নদীর কয়েকটি বেআইনি বালিঘাটের দখল নিয়ে সিপিএম ও ফরওয়ার্ড ব্লকের দু’টি গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদ চলছিল। সে দিনের নিহতেরা ছিলেন তারই এক গোষ্ঠীর লোক। অন্য গোষ্ঠীটি ছিল ফরওয়ার্ড ব্লক আশ্রিত। ওই সময় মনিরুল ইসলাম ছিলেন সংশ্লিষ্ট লাভপুরের দাঁড়কা পঞ্চায়েতের ফব উপপ্রধান। ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের পরে মনিরুলের হাত ধরে বালিরঘাটের সঙ্গে যুক্ত ফব ব্লকের গোষ্ঠীটি তৃণমূলে যোগ দেয়। কিন্তু দু’পক্ষের বিবাদ তখনও থামেনি। বরং চরমে ওঠে। এক সময় বালিঘাট বন্ধ হওয়ার উপক্রম দেখা দেয়। দু’পক্ষই ক্ষতির মুখে পড়ে। সেই সময় সিপিএমের গোষ্ঠীটিও তৃণমূলের ছত্রছায়ায় চলে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, সেই অনুযায়ী দু’পক্ষকে নিয়ে ৪ জুন ২০১০ সালের সন্ধ্যায় তৃণমূলের জেলা সহ-সভাপতির পদে থাকা মনিরুলের নবগ্রামের বাড়িতে সালিশি ডাকা হয়। সেখানে সিপিএম আশ্রিত গোষ্ঠীর হয়ে যোগ দেন একই পরিবারের পাঁচ ভাই জাকের আলি, কোটন শেখ, ওইসুদ্দিন শেখ, জামাল শেখ, সানোয়ার শেখ-সহ সাত জন। কিন্তু বিবাদ মেটার বদলে বচসা চরমে ওঠে। অভিযোগ, ওই সালিশিতেই মনিরুলের নেতৃত্বে জাকের, কোটন ও ওইসুদ্দিন শেখকে পিটিয়ে ও বোমা মেরে খুন করা হয়। জামালকে মৃত ভেবে মাঠে ফেলে দেওয়া হয়। সানোয়ার-সহ অন্য দু’জন (তাঁদের দুই ভাইপো) মারাত্মক ভাবে জখম হয়ে কোনও মতে পাঁচিল টপকে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচান।
ঘটনার পর দিন সকালে নবগ্রামে মনিরুলের ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কার্যত দক্ষযজ্ঞ চলেছে। বাড়ির রান্নাঘর লাগোয়া দাওয়ার স্থানে স্থানে রক্তের দাগ তখনও স্পষ্ট ছিল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ইট-পাটকেল, লাঠি, বহু চটি-জুতো। মনিরুলের বাড়ির অদূরে গাছতলাতেও ছিল রক্তের দাগ। গ্রামবাসীরা জানান, মনিরুলের বাড়ি থেকে মৃতদেহগুলি বের করে ওই গাছতলাতেই ফেলে দেওয়া হয়েছিল। পরে পুলিশ তা উদ্ধার করেছিল। ৫ জুন ওই হত্যাকাণ্ডে মনিরুল-সহ ৫১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়। মাস দু’য়েক পালিয়ে বেড়ানোর পরে সে বছরই অগস্টে পুলিশ মনিরুলকে ধরতে সমর্থ হয়। ৯০ দিনেও পুলিশ চার্জশিট দিতে না পারায় জামিনে ছাড়া পান মনিরুল। এরপরেই বিধানসভা ভোটে দলের টিকিট পেয়ে লাভপুরের বিধায়ক হন এলাকার এই দাপুটে নেতা। তারপর থেকেই দলীয় বিধায়ককে নির্দোষ প্রমাণ করতে শাসক দল উঠে পড়ে লাগে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। সিপিএমের লাভপুর জোনাল সম্পাদক পল্টু কোঁড়া বলেন, “ওই ঘটনায় রাজ্য সরকার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পুলিশকে ব্যবহার করল। যার বাড়িতে খুন হয়েছে, তার বিরুদ্ধে অন্তত খুনের ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগটুকুও আনা যেত। বিরোধী দলের কেউ এমন ঘটনায় অভিযুক্ত হলে, পুলিশ কি তাঁদের ছেড়ে দিত?”
এ দিন মনিরুলের নবগ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল তালা ঝুলছে। কিছুটা দূরেই মসজিদ। সেখানে জটলা স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের। সংবাদমাধ্যমে চার্জশিটে মনিরুলের নাম-উধাও প্রসঙ্গটিই তাঁদের আলোচনার বিষয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁদেরই কেউ কেউ বলেন, “সবাই জানে মনিরুলের বাড়িতেই ওই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। পুলিশ সে কথা আগেই আমাদের কাছ থেকে জেনে গিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও চার্জশিট থেকে তাঁর নামটাই বাদ দেওয়া হয়েছে!” রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা থেকেই পুলিশ এমনটা করেছে বলে তাঁরা মনে করছেন। গ্রামের অন্য অংশ অর্থাৎ নিহতদের পাড়ায় গিয়ে দেখা গেল, তাঁদের পরিবারের বাড়িগুলি কোনওটি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে, কোনওটি আবার তালাবন্ধ হয়ে পোড়ো বাড়িতে পরিণত হয়েছে। পাড়ার এক বাসিন্দা বলেন, “শুধু পরিবারের তিন সদস্যকেই নয়, দীর্ঘ দিনের আশ্রয়ও হারাতে হয়েছে জরিনা বিবিদের। অত বড় পরিবারের সদস্যদের এখন কে কোথায় আছেন, তার ঠিক নেই। কত বছর ধরে তাঁদের জমি জায়গাও অনাবাদী হয়ে পড়ে রয়েছে।”
এমনিতে বহু দিন ধরেই মামলাটি ঠান্ডা ঘরে চলে গিয়েছিল। গত পঞ্চায়েত ভোটের সময় হঠাৎই বিতর্কিত মন্তব্য করে মনিরুল নিজেই ভস্মে ঘি ঢালেন। সাঁইথিয়ায় দলীয় প্রচার সভায় দলীয় সাংসদ শিশির অধিকারী ও অনুব্রতর উপস্থিতিতে তিনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেন, “নীহার দত্তের (প্রয়াত প্রাক্তন জেলা কংগ্রেস সভাপতি) ছেলে বাপি দত্ত শুনে রাখ। বাপি দত্তের মুণ্ডুটা আয়দা (আদায়) করতে আমার আমার এক মিনিট দেরি হবে না!” তাঁর পরেই তিনি দাবি করেন, “আমি লাভপুরের বিধায়ক পায়ের তল দিয়ে, মাইয়াটার উপর দিয়ে যারা অত্যাচার করেছিল, তাদের তিন জনকে পায়ের তল দিয়ে মেরে দিয়েছি!” ওই মন্তব্যের পরে তিনি ঘটনায় কোন মেয়ের উপরে অত্যাচারের কথা বলেছেন, তার কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি। বৃহস্পতিবারও ফের তাঁর সঙ্গে এ নিয়ে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এমনকী, ফোনে পাঠানো মেসেজেরও উত্তর দেননি। তবে, নিহতের ভাই আনারুল শেখ বলেন, “মনিরুল আসলে শাক দিয়ে মাঠ ঢাকার চেষ্টা করছেন। নিজেকে জনসমক্ষে হিরো প্রতিপন্ন করার জন্য মেয়ের গল্প ফেঁদেছেন। এলাকার সবাই জানে বালিঘাটের বিবাদের মীমাংসার বাহানায় সালিশি সভায় ডেকে পরিকল্পিত ভাবে আমার দাদাদের খুন করা হয়েছিল।”
একই বক্তব্য নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক নবগ্রাম, লাগোয়া শাঁখপুর, সাওগ্রামের বাসিন্দাদেরও। তাঁদের অনেকেই বর্তমানে তৃণমূলেরই কর্মী। নামপ্রকাশ না করার শর্তে তাঁরাও বলছেন, “ওই সময় এলাকায় কোনও মহিলার সম্মানহানির ঘটনা ঘটেনি। বরং মনিরুলের বাড়িতে যে হত্যাকাণ্ড হয়েছিল, তা প্রমাণিত। পুলিশ তাঁর বাড়িতে রক্তের দাগ দেখে গিয়েছিল। গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে আসল ঘটনার কথাও জেনে গিয়েছিল।”
“মনিরুল আসলে শাক দিয়ে মাঠ ঢাকার চেষ্টা করছেন। নিজেকে জনসমক্ষে হিরো প্রতিপন্ন করার জন্য মেয়ের গল্প ফেঁদেছেন। এলাকার সবাই জানে বালিঘাটের বিবাদের মীমাংসার বাহানায় সালিশি সভায় ডেকে পরিকল্পিত ভাবে আমার দাদাদের খুন করা হয়েছিল।”
নিহতদের ভাই আনারুল শেখ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy