এ যেন ঠিক প্রশ্নপত্র ফাঁস! তবে, খাঁটি প্রশ্নপত্রই ‘ফাঁস’ হয়েছে কি না, জানা নেই কারও। আদৌ প্রশ্নপত্র ‘ফাঁস’ হয়েছে কি না, তা নিয়েও বিভ্রান্ত ‘পরীক্ষার্থীরা’।
কিন্তু, মুখে মুখে সেই ‘প্রশ্নপত্র’-এর (যা আদতে ওয়ার্ড-ভিত্তিক সংরক্ষণের তালিকা) কথা ছড়িয়েছে বাঁকুড়া জেলার তিন পুরসভাতেই। ফলে, জল্পনা ছড়িয়েছে জোর। আর তাতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন ‘পরীক্ষার্থীরা’। অর্থাত্, বিদায়ী কাউন্সিলরদের একটি বড় অংশ। তবে, মাথাব্যথা বেশি শাসকদলের কাউন্সিলরদেরই। কারণ, সংরক্ষণের ঠেলায় গড়চ্যুত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে অনেক কাউন্সিলরেরই। সরকারি ভাবে ওই সংরক্ষণ-তালিকা প্রকাশ না হলেও, বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর ও সোনামুখী পুরসভায় ঢুকে পড়েছে আর এক তালিকা। আর সেই তালিকার তথ্যকে ‘খাঁটি’ বলেই দাবি করছেন শাসক দলেরই একাংশ। জল্পনা যত বাড়ছে, ততই তৃণমূল কাউন্সিলরদের কারও কারও মুখ চুন। কারও মুখে আবার হাসি ধরছে না।
সব মিলিয়ে ‘প্রশ্নপত্র-ফাঁস’ কাণ্ডে জেলার তিনটি পুরসভাতেই ঘনিয়েছে বিভ্রান্তির মেঘ। যদিও বিষ্ণুপুরের পুরপ্রধান তথা রাজ্যের মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এই তালিকাকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে নারাজ। তাঁর কথায়, “সরকারি ভাবে ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত এই তালিকার কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। তাই এ বিষয়ে এখনই কিছু বলা যাবে না।”
“নির্বাচন কমিশন ওয়ার্ড-ভিত্তিক যে সংরক্ষণের তালিকা পাঠিয়েছে,
তা আপাতত প্রকাশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। যখন নির্দেশ আসবে,
তখন প্রকাশ করা হবে।” বিজয় ভারতী, বাঁকুড়ার জেলাশাসক
জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ওই তিন পুরসভার ওয়ার্ডগুলিতে নতুন করে সংরক্ষণ-তালিকা প্রকাশ হওয়ার কথা। নির্বাচন কমিশন গত সোমবার এই তালিকা প্রকাশ করার চূড়ান্ত দিন ঠিক করেছিল। সেই মোতাবেক সংরক্ষণ-তালিকা বাঁকুড়া জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠিয়েও দেওয়া হয়। কিন্তু, শেষ মুহূর্তে নির্দিষ্ট দিনে তালিকা প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন। আপাতত ওই তালিকা আলমারি-বন্দি করেই রেখেছে জেলা প্রশাসন। কবে, তা প্রকাশ হবে সে ব্যাপারে প্রশাসনও অন্ধকারে। জেলাশাসক বিজয় ভারতী বলেন, “নির্বাচন কমিশন যে সংরক্ষণ তালিকা পাঠিয়েছে, তা আপাতত প্রকাশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। যখন নির্দেশ আসবে, তখন প্রকাশ করা হবে।”
তবে, এরই মধ্যে একটা তালিকা কোনও ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে জেলার পুরসভাগুলিতে। সেই তালিকায় নাকি সব পুরসভার সমস্ত ওয়ার্ডের সংরক্ষণ সম্পর্কে তথ্য দেওয়া আছে। কী ভাবে তালিকা বেরোল, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে, জেলা প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, “এক বা একাধিক কর্মীর হাত দিয়ে তালিকা ফাঁস হয়ে থাকতেও পারে। কিন্তু, ফাঁস হয়েছেই বলা মুশকিল। কারণ, আসল তালিকায় কী আছে, তা আমরাও জানি না।”
তবে যে তালিকা বাজারে ছড়িয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, শাসকদলের বেশ কিছু হেভিওয়েট প্রার্থীকে নিজের নিজের ওয়ার্ড হাতছাড়া করতে হতে পারে। আবার সংরক্ষণের গুঁতো থেকে রেহাইও পেয়েছেন অনেকে। ‘ফাঁস’ হওয়া তালিকা অনুযায়ী, বাঁকুড়ার পুরপ্রধান শম্পা দরিপার ১০ নম্বর ওয়ার্ড মহিলাদের জন্যই সংরক্ষিত হয়েছে। আর শম্পাদেবীর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর নেত্রী হিসেবে পরিচিত উপ-পুরপ্রধান অলকা সেন মজুমদারের ১২ নম্বর ওয়ার্ডটি তফসিলি জাতি-উপজাতির জন্য সংরক্ষিত হয়েছে। এ কথা চাউর হতেই ‘ফাঁস’ হওয়া তালিকাটিকে ‘মিথ্যা’ ও ‘সাজানো’ বলে দাবি করছেন অলকাদেবীর অনুগামীরা। তাঁদের বক্তব্য, অলকাদেবীকে বিভ্রান্ত করার জন্য চক্রান্ত করে ভুল তালিকা করা হয়েছে। তফসিলি জাতি-উপজাতি ভুক্ত মানুষ ১২ নম্বরের তুলনায় ১০ নম্বর ওয়ার্ডে অনেক বেশি সংখ্যায় রয়েছেন।
তাঁর ওয়ার্ড সংরক্ষণের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছে ধরে নিয়ে খুশির হাওয়া পুরপ্রধানের শিবিরে। শম্পাদেবী বলেন, “কোন ওয়ার্ড সংরক্ষণের তালিকায় আসবে, তা সমীক্ষা করেই ঠিক করেছে নির্বাচন কমিশন। এখানে আমার কোনও হাত নেই। কমিশনের সিদ্ধান্ত সবাইকেই মানতে হবে।”
অন্য দিকে, অলকাদেবীর সাবধানী মন্তব্য, “কোথায় কী তালিকা বেরিয়েছে, জানি না। সরকারি ভাবে তালিকা প্রকাশ হওয়ার পর কোন ওয়ার্ড কী হল, খোঁজ নেব।”
একই ভাবে গড় হারানোর আশঙ্কায় রয়েছেন বিষ্ণুপুর পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান বুদ্ধদেব মুখোপাধ্যায়। তিনি নিজে পুরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা তথা কাউন্সিলর। কিন্তু, ফাঁস হওয়া তালিকা অনুযায়ী, তাঁর ওয়ার্ড তফসিলি জাতিভুক্ত মহিলার জন্য সংরক্ষিত হয়েছে। সত্যিই ওই ওয়ার্ড সংরক্ষিত হলে তিনি কোন ওয়ার্ডে দাঁড়ান, তা নিয়েও জোর জল্পনা চলছে এলাকার তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মধ্যে।
আবার ফাঁস হওয়া তালিকা অনুযায়ী, বিষ্ণুপুরের ১২ নম্বর ওয়ার্ড মহিলা প্রার্থীর জন্য সংরক্ষিত হয়েছে। এই ওয়ার্ডে দীর্ঘ ২৪ বছর কাউন্সিলর হিসেবে রয়েছেন রবিলোচন দে। ভোটযুদ্ধে তিনি বরাবর শেষ হাসি হাসলেও, শেষ অবধি সংরক্ষণের যাঁতাকলে পড়ে তাঁকে নিজের ওয়ার্ড ছাড়তে হতে পারে বলেও জল্পনা শুরু হয়েছে পুরসভায়। দীর্ঘদিনের কাউন্সিলর দিব্যেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই সংরক্ষণের জেরে নিজের ৬ নম্বর ওয়ার্ড ছাড়া হয়ে রয়েছেন বেশ কয়েক বছর। গত পুরভোটে ৭ নম্বর ওয়ার্ডে দাঁড়িয়েও তিনি জেতেন। এ বার সেই ওয়ার্ডটিও নাকি তফসিলি জাতি-উপজাতির জন্য সংরক্ষিত হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। অন্য দিকে, সোনামুখী পুরসভার ১, ৪, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডকে তফসিলি জাতি-উপজাতির জন্য এবং ৩, ৭, ১০, ১৪ নম্বর ওয়ার্ড মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হয়েছে বলে তালিকায় দেখানো হয়েছে।
বাম ও কংগ্রেস কাউন্সিলরদের বেশ কিছু ওয়ার্ডও সংরক্ষণের আওতায় পড়েছে বলে ওই তালিকায় দেখানো হয়েছে। এবং তাঁদের মধ্যেও চাপা উদ্বেগ রয়েছে। যদিও প্রকাশ্যে কেউ-ই উদ্বেগের কথা মানছেন না। বাঁকুড়ার পুরসভার ২২ নম্বর ওয়ার্ড যেমন। এই ওয়ার্ডের সিপিএম কাউন্সিলর স্বরূপ সেন এলাকারই বাসিন্দা। ‘ফাঁস’ হওয়া তালিকার তথ্য মানলে, এই ওয়ার্ডটি মহিলা সংরক্ষিত হয়ে গিয়েছে। যদিও স্বরূপবাবুর কথায়, “তালিকা ফাঁসের কথা আমাদেরও কানে এসেছে। সমস্ত ঘটনা দলকে জানিয়েছি। দলীয় নেতৃত্ব ওই তালিকাকে গুরুত্ব দিতে বারণ করেছে।” কিন্তু, উদ্বেগ কি নেই? স্বরূপবাবুর দাবি, “উদ্বেগ কেন থাকবে? প্রার্থী তালিকা তো দল ঠিক করবে।” সোনামুখীর পুরপ্রধান, সিপিএমের কুশল বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবার দাবি, তাঁরা এমন কোনও তালিকার কথা জানেন না। যদিও ওই পুরসভারই বিরোধী দলনেতা, সোনামুখীর ১১ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর সুজিত মুখোপাধ্যায় বলেন, “তালিকাটা অনেকের হাতেই আছে।”
শাসকদলের একটা বড় অংশে কিন্তু এই তালিকাকে ঘিরে একাধারে ক্ষোভ ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। বহু দলীয় কাউন্সিলর ও তাঁদের অনুগামীরা ‘ফাঁস’ হওয়া তালিকাটি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তালিকার দেওয়া তথ্য আদৌ বিশ্বাসযোগ্য কি না, তার জবাব নেই প্রশাসনিক আধিকারিকদের কাছেও। এই পরিস্থিতিতে দলীয় কর্মীদের বিভ্রান্ত না হওয়ার পরামর্শই দিয়েছেন জেলা তৃণমূলের সভাপতি অরূপ খাঁ। তিনি বলেন, “সরকারি ভাবে কিছু ঘোষণা হওয়ার আগে বিশ্বাস করা উচিত নয়। এই সবই গুঞ্জন ছাড়া আর কিছু নয়। সংরক্ষণ-তালিকা সঠিক সময়েই প্রকাশিত হবে।”
সেই আসল ‘প্রশ্নপত্র’ বা সংরক্ষণ-তালিকা কবে বেরোয়, এখন তারই অপেক্ষায় তিন পুরসভার কাউন্সিলরেরা। কিন্তু ততক্ষণ অবধি জল্পনা ঠেকায় কে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy