কী ভাবে ইভটিজারদের রুখবেন, বডি স্প্রে নিয়ে শেখাচ্ছেন মহিলা থানার ওসি। ছবি: অভিজিৎ সিংহ।
বডি স্প্রে বা চুল বাঁধার একটা ক্লিপই দুষ্কৃতীর হাত থেকে বাঁচতে মেয়েদের কাছে বড় হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। বাঁকুড়া শহরের স্কুল-কলেজে গিয়ে মেয়েদের এই কথাটাই বোঝাচ্ছেন এক তরুণী। নিজেও ইভটিজারদের ধরতে দলবল নিয়ে শহরের অলিগলি থেকে রাজপথে নজরদারি চালাচ্ছেন।
তিনি বাঁকুড়া মহিলা থানার ওসি রমারানি হাজরা।
নিন্দুকেরা বলবেন, এ আর এমন কী! এটাই তো মহিলা থানার ওসি-র কাজ। কিন্তু, বাঁকুড়া জেলা পুলিশের এক কর্তা বলছেন, “সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই ঠিকই। কিন্তু, যেটা যাঁর কর্তব্য, সেটাই বা ঠিক করে করেন ক’জন? এখানেই রমারানি ব্যতিক্রমী। উনি মহিলা থানার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তাঁর কাজ করার তাগিদটা স্পষ্ট।” বস্তুত, শুধু ইভটিজারদের হাত থেকে মহিলাদের রক্ষা করাই নয়, পারিবারিক হিংসা বা অন্যান্য সমস্যায় পড়া মহিলাদের পাশে দাঁড়াতেও দেখা যাচ্ছে ওই তরুণী পুলিশ অফিসারকে।
বর্ধমানের হিরাপুরের দামোদর গ্রামের বাসিন্দা রমারানি এখন বাঁকুড়াকেই নিজের বাড়ি মনে করেন। ইতিহাস নিয়ে স্নাতকোত্তর ও বিএড করা রমা হয়তো শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতেন। কিন্তু চক-ডাস্টার ধরার বদলে শেষ পর্যন্ত দুষ্টের দমনের জন্য হাতে নিয়েছেন হ্যান্ডকাফ। ২০১০-এ সাব ইন্সপেক্টর হিসেবে তিনি পুলিশে যোগ দেন। বাবা নারায়ণচন্দ্র হাজরা রেল কর্মী। দুই বোনের মধ্যে রমারানি ছোট। তাঁর কথায়, “ছোট থেকেই আমার লক্ষ্য ছিল গড়পড়তা মেয়েদের মতো হব না। ডাকাবুকো হব। তাই হয়তো শেষ পর্যন্ত পুলিশের চাকরিটা পেয়ে যাই।”
মহিলাদের উপরে একের পর এক অপরাধ, নির্যাতন, ইভটিজিং রুখতে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাঁকুড়ায় আলাদা করে মহিলা থানা চালু হয়। সেই সময় পুলিশ সুপার ছিলেন মুকেশ কুমার। তিনিই সাব ইন্সপেক্টর রমারানিকে এই থানার ওসি পদে নিযুক্ত করেন। বাঁকুড়া থানা এলাকায় ধর্ষণ, বধূ নির্যাতন, শ্লীলতাহানি, অপহরণ, ইভটিজিং-র মতো ঘটনা ইদানীং অনেকটাই কমেছে বলে পুলিশমহলের দাবি। তবে শুধু অপরাধ দমনের মধ্যেই নিজেকে গুটিয়ে রাখতে চান না আজকের এই নারী। দুষ্কৃতীরা হামলা চালাতে পারে ভেবে মেয়েরা ঘরে বসে থাকবে, তা তিনি মানতে নারাজ। তাই নিজেই স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীদের সচেতন করতে বিশেষ প্রচারেও নেমেছেন।
কী ভাবে অপহরণের উদ্দেশ্যে মহিলাদের নানা টোপ দেওয়া হয়, কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়লে কী ভাবে বেরিয়ে আসতে হবে, কম বয়েসি মেয়েদের তিনি এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল করছেন। মেয়েদের ব্যাগে থাকা দৈনন্দিন ব্যবহারের কিছু জিনিস যেমন বডি স্প্রে, চুল বাঁধার ক্লিপ দিয়েও কী ভাবে দুষ্কৃতীদের ঘায়েল করা যায়, হাতে-কলমে রমারানি শেখাচ্ছেন। সেই সঙ্গে ছাত্রীদের জনে জনে বাঁকুড়া পুলিশের চালু করা মহিলাদের হেল্পলাইনের নম্বরও তিনি জানিয়ে দিচ্ছেন। এতে আর যাইহোক, ওই টোটকা নিয়ে পথে নামতে কিছুটা বাড়তি সাহস পাচ্ছেন শহরের মেয়েরা।
বাঁকুড়ার প্রাক্তন পুলিশ সুপার মুকেশ কুমারের কথায়, “রমাররানির মধ্যে অন্য রকম কিছু বৈশিষ্ট্য দেখেছিলাম বলেই তাঁকে ওসি পদে নিযুক্ত করেছিলাম। তিনি ভালভাবে কাজ করে তা প্রমাণ করেছেন। এমনকী স্কুল কলেজে ওঁর সচেতনতা সভাগুলি দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ওকে দেখে বহু মহিলাই সাহস পেয়েছেন।” বর্তমান জেলা পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীর কুমারেরও বক্তব্য, “বাঁকুড়া মহিলা থানার কাজ একটা দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে। তদন্তে গতির দিকেও নজর কেড়েছে। মহিলাদের জন্য আলাদা করে হেল্প লাইন চালু করে জনসংযোগ বাড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি মহিলাদের সচেতন করে তুলতেও বিশেষ পদক্ষেপ করেছে বাঁকুড়া মহিলা থানা।”
অপরাধ রুখতে জনসংযোগকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন রমারানি। তাই শহরের নানা স্তরের মহিলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্কুল, কলেজগুলির সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেন তিনি। সম্প্রতি জেলায় ঘটে যাওয়া দু’টি অপহরণের ঘটনায় দ্রুত দোষীদের গ্রেফতার করে কড়া পদক্ষেপ করতে দেখা গেছে বাঁকুড়া মহিলা থানাকে।
সিনেমায় নামানোর টোপ দিয়ে বিষ্ণুপুরের রামানন্দ কলেজের এক ছাত্রীকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে বিষ্ণুপুরের ছিন্নমস্তা এলাকার যুবক শুভেন্দু গুহর বিরুদ্ধে। অভিযোগ পাওয়ার দু’দিনের মাথায় মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে অভিযুক্ত যুবককে পশ্চিম মেদিনীপুরের গোদাপিয়াশাল স্টেশন থেকে গ্রেফতার করে ওই তরুণীকে উদ্ধার করেন রমারানি। এরপর ফেসবুকে বন্ধুত্ব পাতিয়ে বাঁকুড়া শহরের এক তরুণীকে হাওড়ার নিশ্চিন্দা এলাকায় নিয়ে গিয়ে একটি ঘরে বন্দি করে রাখার অভিযোগ ওঠে এক যুবকের বিরুদ্ধে। এ ক্ষেত্রে অভিযোগ পাওয়ার একদিনের মাথায় ঘটনাস্থলে গিয়ে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে ওই যুবতীকে উদ্ধার করে আনেন রমারানি। একই ভাবে একাধিক ধর্ষণের ঘটনাতেও তাঁকে সক্রিয় ভাবে দেখা গিয়েছে।
এ ছাড়াও ইভটিজিং রুখতে নিয়মিত সাদা পোশাকের মহিলা পুলিশের টহল শুরু করেছেন বাঁকুড়া শহরে। বাঁকুড়ার স্কুলডাঙা, চাঁদমারিডাঙা, কলেজরোড, যোগেশপল্লি, কালিতলা, পাঁচবাগা, রানিগঞ্জমোড়ের মতো এলাকাগুলিতে মেয়েদের কখনও সখনও উত্ত্যক্ত করতে দেখা যেত। সম্প্রতি এই সব এলাকায় সাদা পোশাকের মহিলা পুলিশের ঘোরা ফেরার জেরে ইভটিজিংয়ের মাত্রা অনেকটাই কমেছে বলে মত এলাকাবাসীর।
বাঁকুড়ার পাঠকপাড়ার যুবক সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “ইদানীং সাদা পোশাকে মহিলা পুলিশের ঘোরাফেরা শহরে বেড়েছে। ইভটিজিং করতে গিয়ে মহিলা পুলিশের হাতে মারও খেয়েছে অনেকে। এই সব ঘটনা শুনে অনেক দুষ্ট ছেলেই এখন শান্ত হয়ে গিয়েছে।” বাঁকুড়ার ডিএসপি (শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণ) বাপ্পাদিত্য ঘোষ বলেন, “রমারাণির উদ্যোগে শহরে নারী নিগ্রহের ঘটনায় অনেকটাই লাগাম টানা গিয়েছে। আমরা সবরকম ভাবে ওকে উৎসাহ দিচ্ছি।”
বাঁকুড়া গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সুদীপা মুখোপাধ্যায় জানান, “আগে স্কুল শুরু ও ছুটি হওয়ার সময়ে এলাকায় ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করার অভিযোগ শোনা যেত। এখন স্কুলের সামনে মহিলা পুলিশের ঘোরাফেরার জেরে ইভটিজিং নিয়ে অভিযোগ ইদানীং অনেকটাই কমেছে।” একই অভিজ্ঞতা বাঁকুড়ার সারদামণি গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ সিদ্ধার্থ গুপ্তেরও। এই কলেজে একাধিকবার রমারানি ছাত্রীদের নিয়ে অনুষ্ঠান করেছেন। সিদ্ধার্থবাবুর কথায়, “শুধু অনুষ্ঠান করেই দায় সারেন না উনি। প্রায়ই কলেজে এসে কোনও সমস্যা রয়েছে কি না সেই খবর নেন। ছাত্রীদের সঙ্গেও কথা বলেন।” কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী তথা ছাত্রী সংসদের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক স্নেহা দাস বলেন, “মহিলা ওসিকে আমার বান্ধবীরা বিভিন্ন জায়গায় ইভটিজিং হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছিল। এখন সেই সব জায়গায় ইভটিজিং আর হতে দেখা যায় না। পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে। এ ছাড়া আত্মরক্ষার কিছু কৌশলও রমাদি আমাদের শিখিয়েছেন।”
এত প্রশংসায় কিন্তু মাথা ঘুরে যাচ্ছে না মহিলা থানার ওসি-র। বরং নিজের কাজের পরিধি আরও বাড়ানোটাই তাঁর লক্ষ্য। রমারানির কথায়, “মহিলাদের নিরাপত্তা আর সুবিচার দেওয়াই আমাদের লক্ষ। এই কাজটাই মন দিয়ে করার চেষ্টা করছি। পুলিশ হওয়ার স্বপ্ন ছিল। তা পূরণ হয়েছে। এ বার সমাজের সর্বস্তরেই মহিলাদের সমস্যা দূর করতে চাই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy