অবৈধ ভাবে চলছে বালি তোলা। ইনসেটে, মকর স্নানে গিয়ে অজয় নদে তলিয়ে যাওয়া ছাত্র রাহুল। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত।
ফের পুরনো স্মৃতি উস্কে দিল জয়দেব কেঁদুলি মেলা। গত বার মকর স্নান করতে এসে অজয়ে অবৈধভাবে বালি তোলার জন্য তৈরি হওয়া গর্তে তলিয়ে গিয়ে মৃত্যু হয়েছিল এক তরুণের। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল এ বারও। বন্ধুদের সঙ্গে মকর স্নানে এসে বালি তোলার গভীর গর্তে তলিয়ে গিয়ে মৃত্যু হল এক স্কুল পড়ুয়ার। পুলিশ জানিয়েছে মৃতের নাম রাহুল কর (১৭)। বাড়ি দুর্গাপুরের বেনাচিতি নেতাজিনগর কলোনিতে।
বৃহস্পতিবার দুর্ঘটনার প্রায় ঘণ্টা দু’য়েক পরে দেহ উদ্ধার করে পুলিশের ডিজাস্টার ম্যানেজম্যান্ট গ্রুপের সদস্যরা। কিন্তু ফি বছর জয়দেব কেঁদুলি মেলায় আসা পুণ্যার্থীদের মকর স্নানের সময় এমন দুর্ঘটনা নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও অবৈধ বালি কারবার নিয়ে প্রশাসনিক উদাসীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও প্রশাসন দাবি করছে, যেখানে ঘটনাটি ঘটছে তা মকর স্নানের মূল ঘাটগুলির থেকে অনেক দূরে। তাই বিষয়টি নজরদারিতে ছিল না।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, অজয়ে মকর স্নান সেরে মেলা দেখার জন্য এ দিন বৃহস্পতিবার সকালে দুর্গাপুর থেকে পাঁচ বন্ধুর সঙ্গে জয়দেব আসে রাহুল। বিভিন্ন ঘাটে অসংখ্য মানুষের ভিড় বেশ ছিলই। ভিড় ও নোংরা এড়িয়ে নিজেদের মতো জয়গা বেছে নিতে মেলা প্রাঙ্গণের ডানদিকে অজয় নদ ধরে প্রায় দেড় কিমি দূরে পৌঁছেগিয়েছিল রাহুলরা। জলে নামার কিছুক্ষণের মধ্যেই তলিয়ে যায় সে।
ঠিক কী ঘটেছিল এদিন? রাহুলের পাঁচ বন্ধু ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিজিত্ কোঁড়া, কৃষ্ণগোপাল মর্দন, দিব্যেন্দু নন্দী, অভিরূপ দাঁ জানিয়েছে, তারা সকলেই এ বার উচ্চ মাধ্যমিক দেবে। একমাত্র অভিরূপ ছাড়া বাকিরা ভিড়িঙ্গি টিএন ইন্সটিটিউটের ছাত্র। অভিরূপ পড়ে ডিপিএল বয়েজ স্কুলে। কিন্তু সকলেই এক জায়গায় টিউশন পড়ে। তাদের কথায়, “আমরা একটু ফাঁকা দেখে অজয়ে স্নানের জন্য একটা জায়গা পছন্দ করি। সেখানে কয়েকজন স্নান করছিলেন। আমাদের মধ্যে বেশিরভাগই কিছুটা সাঁতার জানে। শুনেছি রাহুলও অল্প সাঁতার জানত। একমাত্র দিব্যেন্দু সাঁতার না জানায় সে জলে নামেনি। পাঁচজন জলে কোমর পর্যন্ত নেমে স্নান করছিলাম। এমন সময় ওই ঘাটে অন্য যাঁরা স্নান করছিলেন তাঁরা বলেন জল নোংরা না করতে। এই সময় কথা বলতে বলতে নদীতে পেছনের দিকে হাঁটতে হঠাতই বালি তোলা গভীর গর্তে তলিয়ে যেতে থাকে রাহুল। তখন কয়েকজন পাড়ে উঠে এসেছি। আমাদের মধ্যে একজন রাহুলের কাছাকাছি ছিল। কিন্তু সে তেমন সাঁতার না জানায় কোনও সাহায্য করতে পারেনি!” তাদের আক্ষেপ, “এত তাড়াতাড়ি সবকিছু ঘটে যায় প্রথমটা অমরা খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তারপর খোঁজাখুঁজি করে না পাওয়ায় ১০০ ডায়াল করি। কিন্তু তাতে পুলিশ আসতে দেরি হওয়ায় আমরা পুলিশ ক্যাম্পে এসে খবর দিই।” পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রথমে সিভিল ডিফেন্স দেহ খুঁজে পেতে অসমর্থ হওয়ায় ডিজাস্টার ম্যানেজম্যান্ট টিম রাহুলের দেহ উদ্ধার করে ইলামবাজার হাসপাতালে পাঠায়।
এ ভাবে দুর্ঘটনা ঘটা নিয়ে ক্ষুব্ধ অজয়ে মকর স্নানে আসা পুণ্যার্থীরা। তাঁদের প্রশ্ন, বালি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যে অজয়ে যে বিশাল বিশাল গর্ত হয়ে রয়েছে সে ব্যাপারে কেন আরও বেশি সতর্ক নয় প্রাশাসন। সতর্কবার্তা দেওয়া বা মাইকে ঘোষণা করার কেন ব্যাবস্থা ছিল না প্রশাসনের তরফে। যেখানে আগের বারও এমন ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বালি মাফিয়ারা যে বালি তুলে নিয়ে নদী গর্ভে অসংখ্য মরণ ফাঁদ বানিয়ে রেখেছে সে ব্যাপারে প্রশাসন উদাসীন। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক কিছু বাসিন্দা বলছেন, “মেশিন বা নৌকা থেকে পাম্প জাতীয় যন্ত্র ব্যবহার করে বালি তোলা হয়। বর্ষার জল কমতেই রমরমিয়ে কারবার চলে। ওই গর্ত জলে ঢেকে গিয়ে কোথাও হাঁটু জল তো, কোথাও ২০-২৫ ফুট গর্ত। বালি তোলার জন্যই যে এই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে তা মেনে নিয়েছেন পুলিশ প্রাশাসনের এক কর্তা। তাঁর কথায়, “হঠাত্ এমন গর্ত জলের তলায় লুকানো থাকলে বিপদ হতেই পারে।”
কী ভাবছে প্রাশাসন? এই মূহূর্তে নদী থেকে অবৈধ ভাবে মেশিন লাগিয়ে বালি তোলা যে দফতরের দেখার কথা, সেই সেচ দফতরের সুপারিন্টেডেন্ট ইঞ্জিনিয়র সুজিত কোনার বলেন, “অবৈধভাবে বালি তোলা আটকাতে নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া স্বল্প সময় ও দীর্ঘ সময়ের জন্য বালির দরপত্র দেওয়া হয়। দেখতে হবে এ কাজ করা করছে।” তাঁর সাফাই, “আরও একটি বিষয়, অজয়ের একাটা অংশ বর্ধমানের দায়িত্বে রয়েছে। দেখেত হবে ঠিক কোথায় ঘটনাটি ঘটেছে। তবে খোঁজ নিয়ে দেখছি।” এ দিন জয়দেব মেলার অনুষ্ঠানিক উদ্বোধনে আসা জেলাপরিষদের সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরীর দাবি, “ঘটনাটি ঘটেছে প্রায় দশ কিমি দূরে। মেলার সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই।” তবে বীরভূম জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী বলেন, “যে ঘাটগুলিতে নজরদারি রয়েছে এই ঘটনা সেখানে ঘটেনি। গভীর গর্তে তলিয়ে যাওয়া আটকাতে এ বার প্রশাসনের পক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। বিপদ হতে পারে এমন এমন জায়াগায় বিপদ সঙ্কেত লেখা ছিল। সঙ্গে ছিল নজরদারি। কী ভাবে ঘটল এমন ঘটনা আমরা বিষয়টি দেখছি।”
এ দিন সন্ধ্যায় দেহ নিতে ইলামবাজার থানায় আসা রাহুলের বাবা প্রভাত কর কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না। এক আত্মীয় বললেন, “সকালে তরতাজা ছেলেটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যে আর ফিরবে না বুঝতে পারিনি!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy