ভগ্নপ্রায় ওয়াচ টাওয়ারের উপরে ইংরেজ আমলে তৈরি ট্যাঙ্ক। ছবি: অভিজিৎ সিংহ।
রাস্তার মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালের আলো লাল থেকে রং বদলে হচ্ছে সবুজ। পাকা সড়কে যাত্রী নিয়ে ছুটছে টোটো গাড়ি। ল্যাম্পপোস্টের আলোর ছটা জ্বলজ্বল করছে রাতের অন্ধকারে। শহরের চারপাশে উঠছে উঁচু উঁচু বাড়ি। এ সবের ভিড়েও অনেকের স্মৃতিতে এখনও সতেজ পুরনো বাঁকুড়ার ইতিহাস। ঝাপসা দৃষ্টিতে শহরের বদলে যাওয়ার ছবি দেখে অনেকে তাই বলে ওঠেন, ‘‘কিছু দিন আগেও এখানে শিয়াল ডাকত। কত বদলে গিয়েছে শহরটা!”
ফিরে দেখা যাক, সিপাহি বিদ্রোহের সময়ে কেমন ছিল এই শহর। তরুণদেব ভট্টাচার্যের লেখা ‘বাঁকুড়া’ বই থেকে জানা যাচ্ছে, সে সময়ে বাঁকুড়া থেকে রানিগঞ্জে সা কোম্পানির ঘোড়ার গাড়ি চলত। ১৮৮০ সালে সা কোম্পানি উঠে গেলে ঘোড়ার বদলে উটের গাড়ির চল হয়। সেই গাড়ি আবার দ্বিতল ছিল। টং টং করে ঘণ্টা বাজিয়ে ঘোড়ার গাড়ি চলত। লালবাজার এলাকা থেকে গাড়ি ছাড়ত। সন্ধ্যায় রওনা দিয়ে সেই গাড়ি মেজিয়ার দামোদর নদের ঘাটে পৌঁছতে ভোর হয়ে যেত। বাঁকুড়া শহরেও চলত ঘোড়ার গাড়ি। ঘোড়ার গাড়িগুলির নিজস্ব এক একটি নম্বর থাকত। পুরসভা সেই নম্বর দিত।
বাঁকুড়া পুরসভার জন্ম কবে, তা নিয়ে সম্প্রতি বিতর্ক শুরু হয়েছে। তবে বিভিন্ন নথিপত্র থেকে জানা যাচ্ছে, ১৮৬৯ সালে টাউন কমিটি গঠনের মাধ্যমে বাঁকুড়া পুরসভার পথ চলা শুরু হয়। যদিও বাঁকুড়া পুরসভার ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৮৬৫ সালে প্রথমে বাঁকুড়া মিউনিসিপ্যাল কমিটি গঠন করা হয়েছিল। চার বছর পরে তা বাঁকুড়া পুরসভা হয়। প্রথম দিকে কমিশনার মনোনীত করা হতো। তাঁরা মূলত হয় উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মী, নয়তো ব্রিটিশ সরকারের পছন্দের ব্যক্তি হতেন। কয়েক দশক পরে পুরসভার শুধুমাত্র করদাতারা ভোটাধিকার পান। সবার (১৮ বা তদূর্ধ্ব) ভোটাধিকার চালু হয় অনেক পরে, ১৯৮১ সালে। বাঁকুড়া পুরসভা কমিটির প্রথম সভাপতি ছিলেন ডব্লউ এস ওয়েলস। পরবর্তীকালে প্রথম ভারতীয় হিসেবে পুরপ্রধান হন হরিহর মুখোপাধ্যায়, ১৮৮৫ সালে।
শহর সম্পর্কিত বিভিন্ন বইপত্র থেকে জানা যায়, ঘটক মহল্লা, পাঠকপাড়া, রামপুর, গোপীনাথপুর, পোদ্দারপাড়া, কানকাটা, কেন্দুয়াডিহি, ইদগামহল্লা, নতুনচটি, লালবাজার-সহ ২২টি মহল্লা এই টাউন কমিটির আওতায় ছিল। মোট ১২ জন কমিশনার ছিলেন। বর্তমানে শহরের চকবাজারে থাকা টাউন কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কে প্রথম শুরু হয় পুরসভার কাজ। পরবতীকালে ১৯১৮ সালে গড়া হয় বর্তমান পুরভবনটি। ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন করেন ছোট লাট রোনাল্ডসে।
বাঁকুড়া পুরশহরে নলবাহিত প্রথম জল সরবরাহ চালু হয় ১৯১৬ সালে। তৎকালীন বাঁকুড়া পুরসভার অধ্যক্ষ রেভারেন্ড জন নিচেল এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। জল প্রকল্প চালু করতে খরচ হয়েছিল প্রায় ৫০ হাজার টাকা। ওই বছরই গন্ধশ্বরী নদী লাগোয়া পাঠকপাড়ায় তৈরি করা হয় শহরের সব থেকে প্রাচীন পাম্পিং স্টেশনটি। ওই পাম্পিং স্টেশনের উদ্বোধন করেন ছোট লাট রোনাল্ডসে। গন্ধেশরী থেকে জল তুলে ওই পাম্পিং স্টেশন থেকে শহরে জল সরবরাহ করা হতো। প্রায় ৮ হাজার নাগরিককে দৈনিক প্রায় ৫০ হাজার ৯৫৫ গ্যালন জল সরবরাহ করা হতো।
১৯৪১ সালে বিএন ইলিয়াস অ্যান্ড কোম্পানি পাওয়ার হাউস গড়ে তোলে শহরের পাটপুর এলাকায়। ১৯৪৪ সালে প্রথম বাঁকুড়া শহরের পথে বৈদ্যুতিন ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলে ওঠে। শোনা যায়, তার আগে শহরের গুটিকয়েক জায়গায় বাঁশের খুঁটিতে কেরোসিনের বাতিই ছিল আঁধার ঘোচানোর একমাত্র উপায়। প্রাচীন কাল থেকেই উত্তর ভারতের তীর্থযাত্রীরা বিষ্ণুপুর ও বাঁকুড়া শহরের উপর দিয়ে অহল্যাবাঈ রাস্তা ধরে পুরি যাওয়া-আসা করতেন। তীর্থ যাত্রীদের সুবিধার্থে চকবাজার এলাকায় একটি দাতব্য চিকিৎসালয় চালু করে পুরসভা। শহরের বাসিন্দা রামসদন চট্টোপাধ্যায় তাঁর মায়ের স্মৃতি রক্ষার্থে এই চিকিৎসালয় গড়ে পুরসভাকে হস্তান্তরিত করেছিলেন। সেই গুরুদাসী হোমিওপ্যাথি দাতব্য চিকিৎসালয় এখনও চালু রেখেছে পুরসভা।
চলতি বছর ২০১৪ সালকেই পুরসভার জন্ম সার্ধশতবর্ষ বলে দাবি করছেন পুরপ্রধান শম্পা দরিপা। সেই মোতাবেক শহরে নানা অনুষ্ঠান, মেলা, খেলাধুলোর আয়োজন করা হয়েছে বছরভর। তবে এ নিয়ে বিতর্কের সূচনা পুরভবনের দেওয়ালে লেখা স্থাপনের সময় ১৮৬৯ সাল লেখাকে ঘিরে। যদিও ওই সময়কাল লেখা ফলক ফেলে দিয়ে পুর কর্তৃপক্ষ নতুন করে সময়কাল হিসেবে ১৮৬৫ লেখেন। বিজেপি-র রাজ্য সহ সভাপতি সুভাষ সরকার অভিযোগ তুলেছিলেন, “সামনেই পুরভোট। তাই পুরসভার বয়স বাড়িয়ে সাধশর্তবর্ষের অনুষ্ঠান করে ভোট বাড়ানোর কৌশল নিয়েছে তৃণমূল।” যদিও পুরপ্রধানের দাবি, “আমাদের কাছে নানা নথি আছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে ১৮৬৫ সালেই টাউন কমিটি গড়ে উঠেছিল। সেই সময় টাউন কমিটির বিভিন্ন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেটাই পুরসভার গঠন বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে।” তবে পুর শহরের ইতিহাসের অনেকটাই এখন কালের গর্ভে। শম্পাদেবীর আক্ষেপ, “পুরনো ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য অনেকেই যত্নশীল হননি। তাই হারিয়ে গিয়েছে বহু তথ্যই। যে সব তথ্য এখনও রয়েছে আমরা সেগুলি সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেব।” তবে সেই কাজ করতে গিয়ে ইতিহাসের বিকৃতি না ঘটানো হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলছেন পুরবাসী।
এ তো গেল পুরসভার ইতিহাসের কথা। গত কয়েক দশকের মধ্যেই বাঁকুড়া শহরের রূপরেখার পরিবর্তন কতটা হয়েছে, তা এই শহরের প্রবীন নাগরিকদের সঙ্গে কথা বললেই মালুম হয়। প্রবীন বাসিন্দা তথা কবি অবনী নাগ জানান, প্রতাপবাগান, অরবিন্দনগর, কমরারমাঠ, জুনবেদিয়ার মতো শহরের বর্তমান জনবহুল এলাকাগুলি সত্তরের দশক পর্যন্ত ছিল জঙ্গলময়। হিংস্র জন্তু ও ডাকাতের ভয়ে বেলাতেও লোকে ওই সব জায়গায় যেতে ভয় পেতেন। আবর্জনা ফেলা হতো প্রতাপবাগান এলাকায়। রানিগঞ্জ মোড় এলাকায় দিন দুপুরেও ঘরে ঢুকে পড়ত শিয়ালের দল। তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, “কমরার মাঠ এলাকায় এক ব্যক্তি আমাকে পাঁচ টাকা কাঠা হিসেবে জায়গা বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। আমি বলেছিলেন ওখানে ভূত রয়েছে, রাতে পেত্নি কাঁদে। ওই সব জঙ্গলে কে থাকতে যাবে? বিনা পয়সাতেও নেব না। এখন কমরার মাঠের সারি সারি অট্টালিকা দেখে সেই জঙ্গলময় পুরনো ছবির সঙ্গে মেলানোই যায় না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy