হাট এগিয়ে এসেছে রাস্তায়। যানজটের ফাঁসে চলাই দায়। পরিবহণ নিয়েও রয়েছে ক্ষোভ।
সে রাজাও নেই, রাজ্যপাটও নেই। কিন্তু কালের নিয়মেই আড়ে বহরে বেড়েছে এই জনপদও। কাশীপুরকে ঘিরে থাকা গড়চড়, নারায়ণগড়, দৈকিয়ারি, কেলিয়াথোল, তালগোড়ার মতো মৌজাগুলি এখন মিশে গিয়েছে কাশীপুরের সঙ্গে। এই গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় গ্রাম সংসদের সংখ্যা ১২টি। জনসংখ্যা ২৫ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। কলেজ, উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ, প্রাথমিক বিদ্যালয়, বেসরকারি বিদ্যালয়, উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিশুশিক্ষা কেন্দ্র মিলিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৮। জেলার সবচেয়ে বেশি গ্রাম পঞ্চায়েত (১৩টি) নিয়ে গড়ে ওঠা ব্লক সদর কাশীপুর এখন জেলার উত্তর-পূর্ব এলাকার অন্যতম প্রধান গ্রামীণ বাণিজ্য কেন্দ্রও।
সেই বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে পঞ্চকোটের তত্কালীন মহারাজা জ্যোতিপ্রসাদ সিংহ দেও বাঁকুড়ার বাসিন্দা জনৈক মতিলালবাবুর পরামর্শে কাশীপুরে একটি সাপ্তাহিক হাট চালু করেছিলেন। সে সময় এই এলাকায় ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য কোনও বড় বাজার ছিল না। প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার হাট বসে। শতবর্ষ পেরিয়ে আজও একই রয়ে গিয়েছে। কিন্তু রাজার চালু করে যাওয়া এই হাটের পরিষেবার দিকে নজর দেয়নি প্রশাসন। অধিকাংশ ব্যবসায়ীর মাথায় ছাউনি নেই। নেই পানীয় জলের ব্যবস্থা, শৌচাগার। এতে মহিলাদের সমস্যা বেশি। দিনদিন বিক্রেতা বাড়ায় সপ্জির পসরা এখন রাস্তার দু’পাশে চলে এসেছে। এতে রাস্তা সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ায় যানজট পাকিয়ে থাকে দিনভর। পুরুলিয়া চেম্বার অব ট্রেড এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি গোবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, “১০০ বছর আগে এলাকার মানুষজনের দৈনন্দিন জিনিসপত্র হাতের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং এলাকার অর্থনীতি মজবুত করতে রাজা যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, পরবর্তীতে সেই হাটের পরিকাঠামো গড়ে তোলায় সরকারি উদ্যোগ সে ভাবে নেই।”
বাসিন্দাদের অভিযোগ, দিনে দিনে কাশীপুর বাড়ছে, মানুষজনের সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু সে তুলনায় বাড়েনি পরিষেবার মান। জেলা শহর পুরুলিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনও ততটা ভাল নয়। আদ্রা থেকে কাশীপুরের দূরত্ব সাত কিলোমিটার। এই পথের ভরসা বলতে গুটিকয়েক বাস ও ছোট গাড়ি। কিন্তু কখন বাস ছাড়বে, তার কোনও ঠিক থাকে না বলে অভিযোগ। তার উপরে ছোটগাড়িগুলিতে যত যাত্রী বসার জায়গা থাকে, যাত্রী তোলা হয় তার প্রায় দ্বিগুণ। তা না হওয়া পর্যন্ত গাড়ি যাত্রা করে না। অগত্যা ঝুঁকি নিয়েই যাতায়াত করতে হয়। তবে দুর্ভোগ বাড়ে সন্ধ্যার পরে। তখন গাড়ি বেশ কমে যায়। যাত্রীদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ছোট গাড়িগুলি চড়া দর হাঁকে বলেও অভিযোগ। যাত্রীদের কথায়, বিস্তীর্ণ এলাকার কয়েক হাজার মানুষ এই রুটে যাতায়াত করেন। কিন্তু প্রশাসনের যাত্রী পরিবহণের ব্যাপারে কোনও নজর নেই। তাঁরা বেসরকারি গাড়ি চালকদের তুঘলকি কাজ বন্ধ করতে এ বার সরকারি বাস চালুর দাবি তুলেছেন। প্রশাসনের তরফে অবশ্য সে ব্যাপারে আশ্বাস মেলেনি। তবে জেলা পরিবহণ দফতর জানিয়েছে, এই রুটে (আদ্রা-কাশীপুর) যাঁরা ছোট গাড়ি চালাতে চান, তাঁরা দফতরের কাছে আবেদন জানালে অনুমতি দেওয়া হবে। আবেদন করতে হবে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে।
কাশীপুর-আদ্রা এ ভাবেই ঝুঁকি নিয়ে যাত্রা করতে হয়।
এই এলাকায় স্বাস্থ্য পরিষেবার ভরসা বলতে কল্লোলী ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এখানে শয্যার সংখ্যা ৩০। স্বাস্থ্যকেন্দ্র সূত্রে জানা গিয়েছে, রোগী ভর্তি থাকে তার চেয়ে বেশি। চিকিত্সক থাকার কথা ব্লক মেডিক্যাল আধিকারিক-সহ পাঁচজন। কিন্তু বর্তমানে এখানে রয়েছেন মোটে তিনজন চিকিত্সক। ফার্মাসিস্ট দু’জনের বদলে রয়েছেন একজন। স্টাফ নার্স থাকার কথা ১০ জন। রয়েছেন আটজন। জিডিএ ন’জনের বদলে রয়েছেন সাতজন। চতুর্থ শ্রেণির কর্মী তিনজনের বদলে একজন। জেনারেটর থাকলেও চলে না। অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। কর্মীরা জানিয়েছেন, তাঁদের আবাসনগুলির অবস্থাও ভাল নয়। বিএমওএইচ-এর আবাসন এমনই বেহাল যে তিনি নিজেই থাকেন অন্য মেডিক্যাল অফিসারের আবাসনে।
বিএমওএইচ নেতাজি সিং সর্দার জানিয়েছেন, “নানা সমস্যার মধ্যেই আমরা পরিষেবা দিচ্ছি।” বাসিন্দাদের বক্তব্য, রোগীর অবস্থা একটু খারাপ হলেই হয় বাঁকুড়া, নয়তো পুরুলিয়ায় স্থানান্তর করা হয়। এ দিকে রাস্তা খারাপের জন্য বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে রোগী নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত কষ্টকর। এই কাশীপুর-বাঁকুড়া রাস্তাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও প্রশাসনের নজর নেই। কাশীপুরের বিধায়ক স্বপন বেলথরিয়াও স্বীকার করেন, “এই এলাকার স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল অত্যন্ত দুর্বল।” তাঁর আশ্বাস, এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিকে ১০০ শয্যার হাসপাতালে রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এখানে সুদৃশ রাজবাড়ি ও প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং আদ্রা রেলশহরের কাছে বলে প্রায়ই এখানে শ্যুটিংয়ের তাঁবু ফেলছেন বিভিন্ন চিত্র পরিচালকেরা। পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর কথায়, “এই রাজবাড়ি একটা অন্যরকম সৌন্দর্য রয়েছে।” তিনি একাধিক ছবি করে গিয়েছেন এখানে। এলাকার বাসিন্দা শিবপ্রসাদ দত্তর কথায়, “পর্যটনের সম্ভাবনা থাকলেও রাস্তা বেহাল। পরিকাঠামোও গড়ে উঠছে না। অনেক রাস্তাতেও আলো নেই। বেশ কিছু রাস্তা খানাখন্দে ভরা। অন্তত প্রধান রাস্তাগুলির অবস্থার দিকে নজর দিক প্রশাসন।”
যাত্রিবাহী বাস দাঁড়ানো নিয়েও সমস্যা দীর্ঘদিনের। হাটতলা মোড়ে রাস্তার উপরেই বাস দাঁড়িয়ে থাকে। তার উপরে রাস্তা দিনে দিনে দখলদারদের হাতে চলে যাচ্ছে। পথচারীদের কথায়, হাটতলা মোড় বেশ কিছুদিন চওড়া হয়েছে বটে। কিন্তু তাতে রাস্তা বাড়েনি। কারণ প্রায় গোটা মোড়টাই দখলদারদের হাতে চলে গিয়েছে। যেখানে সেখানে অবৈধ পার্কিং। তারমধ্যেই দ্রুত ছুটছে বাইক। ট্রাফিক পুলিশ পোষ্ট থাকলেও সেখানে পুলিশের দেখা মেলে না বলে অভিযোগ।” আর এই মোড় পার হয়েই দু-তিনটি বিদ্যালয়ে যাতায়াত করতে হয়ে পড়ুয়াদের। বাসিন্দাদের দাবি, রাস্তা সঙ্কীর্ণ হওয়ায় কিছুদিন আগে এক পথচারী একটি বাসের চাকার নীচে পড়ে প্রাণ হারান। তারপরে কিছুদিন মোড় দখলমুক্ত করা হলেও ফের আগেকার অবস্থাতেই ফিরে গিয়েছে। একই সমস্যা রিকশা নিয়েও। নেই পৃথক রিকশা স্ট্যান্ডও।
কাশীপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সৌমেন বেলথরিয়া বলেন, “পঞ্চায়েত সমিতি থেকে কাশীপুর-আদ্রা রুটে অটো চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যাঁরা ইচ্ছুক, তাঁরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমরা সহায়তা দেব।” তিনি জানান, কিছু এলাকায় পথবাতি লাগানো হয়েছে। আরও আলো লাগানো হবে। সাপ্তাহিক হাটেরও হাল কিছুটা ফেরানো হয়েছে। একে একে সমস্যাগুলি মেটানোর কাজ শুরু হয়েছে।
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া’।
অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া বিভাগ,
জেলা দফতর আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১
ছবি: সুজিত মাহাতো ও প্রদীপ মাহাতো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy