Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
এসএফআই কোথায়, প্রশ্ন পুরুলিয়ায়

তিন আসনে ফের জয়ী এবিভিপি

আগের দিনেই একটি কলেজের ছাত্র সংসদ দখলে এনে অন্য কলেজেও একক ভাবে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখিয়ে দিয়েছে। আর পরের দিন দু’টি কলেজের ‘টাই’ হওয়া চারটি আসনের মধ্যে তিনটিতেই জিতে ফের এবিভিপি বুঝিয়ে দিল, পুরুলিয়া জেলায় তাদের উত্থান বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সোমবার জেলার ১০টি কলেজের নির্বাচন ছিল। তার মধ্যে আগেই চারটি কলেজে টিএমসিপি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যায়।

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল
আদ্রা শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:৪৮
Share: Save:

আগের দিনেই একটি কলেজের ছাত্র সংসদ দখলে এনে অন্য কলেজেও একক ভাবে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখিয়ে দিয়েছে। আর পরের দিন দু’টি কলেজের ‘টাই’ হওয়া চারটি আসনের মধ্যে তিনটিতেই জিতে ফের এবিভিপি বুঝিয়ে দিল, পুরুলিয়া জেলায় তাদের উত্থান বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

সোমবার জেলার ১০টি কলেজের নির্বাচন ছিল। তার মধ্যে আগেই চারটি কলেজে টিএমসিপি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যায়। কিন্তু যে ছ’টি কলেজের ছাত্র সংসদে নির্বাচন হয়, তার অর্ধেক কলেজেই টিএমসিপি হেরে যায়। হুড়ার লালপুর মহাত্মা গাঁধী কলেজের ছাত্র সংসদের ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছে এবিভিপি। ঝালদার অচ্ছ্রুরাম মেমোরিয়াল কলেজেও তাঁরা একক ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাঘমুণ্ডির সুইসার কলেজ দখল করে ছাত্র পরিষদ। টিএমসিপি-র জন্য যে আরও ধাক্কা ছিল, মঙ্গলবার দুপুরেই তা পরিষ্কার হয়ে যায়। হুড়া ও বাঘমুণ্ডির কলেজের মোট চারটি আসনের ফল অমীমাংসিত ছিল। এ দিন ওই আসনগুলিতে পুনরায় নির্বাচন করা হয়। দেখা যায় হুড়ার দু’টি এবং বাঘমুণ্ডির একটি আসনে এবিভিপি জেতে। টিএমসিপি শুধু বাঘমুণ্ডিরএকটি আসনে জেতে।

এই জেলায় কার্যত শূন্য থেকে শুরু করা আরএসএস প্রভাবিত এই ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি) অল্প সময়ের মধ্যে যতটা এগিয়ে গেল, তার থেকেও পিছিয়ে পড়েছে বামপন্থী ছাত্র সংগঠন এসএফআই। আগে কলেজগুলির ছাত্র সংসদে একচ্ছত্র ক্ষমতা ছিল এসএফআই-র। পরে বিরোধী হিসেবে উঠে আসে টিএমসিপি। শুধু ঝালদার মতো কংগ্রেস প্রভাবিত অল্প কিছু এলাকায় ছাত্র পরিষদের কিছুটা অস্তিত্ব ছিল। গত কয়েক বছরে পুরো ছবিটাই উল্টে যায়। ছাত্র সংসদ দখলে চলে আসে টিএমসিপি-র। গত বছর পর্যন্তও এসএফআই বিরোধী হিসেবে নিজেদের ধরে রেখেছিল। কিন্তু এ বার তাদের সরিয়ে বিরোধী জায়গায় চলে এসেছে এবিভিপি।

বিভিন্ন কলেজে প্রার্থী দেওয়ার পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট এসএফআইকে পিছনে ফেলে দ্রুত উত্থান ঘটছে এবিভিপি-র। বস্তুত জেলার ১০টি কলেজের মধ্যে চারটিতে আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিএমসিপি জিতেছে। যে ছ’টিতে নির্বাচন হয়েছে, দেখা যাচ্ছে, সেখানে রীতিমতো কোমর বেঁধেই এবিভিপি নেমেছিল। তুলনায় এসএফআই যেন কিছুটা ছন্নছাড়া। ছ’টি কলেজের ১৩০টি আসনের মধ্যে এসএফআই প্রার্থী দিতে পেরেছিল ৭২টি আসনে। সেখানে এবিভিপি প্রার্থী দিয়েছিল ৮৯টি আসনে। ছ’টি কলেজে এসএফআই জিতেছে মোটে ৮টি আসনে। অন্য দিকে, একটি কলেজ নিজেদের দখলে এনেছে এবিভিপি এবং অন্য একটি কলেজে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতেছে তারা। ছ’টি কলেজে এবিভিপির প্রাপ্ত আসনের সংখ্যা মোট ৩১টি।

এমনটা হল কী করে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে উঠে এসেছে বামপন্থী ছাত্র সংগঠন এসএফআই-র সাংগঠনিক দুর্বলতার দিকটি। জেলার রাজনীতি যাঁরা চর্চা করেন, তাঁদের একাংশের মতে, পুরুলিয়ায় এই বছরেই সাংগঠনিক কাজ শুরু করে এবিভিপি। এসএফআই-র সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণেই এবিভিপি-র উত্থান। এই মত কার্যত স্বীকার করে নিচ্ছেন এসএফআই-র জেলা নেতারাও। এসএফআই-র জেলা সম্পাদক দীপঙ্কর মাঝির কথায়, “আমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতার জন্য টিএমসিপি বিরোধী ছাত্রছাত্রীদের একটা অংশের সমর্থন এবিভিপি-র দিকে যাচ্ছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।”.

এরই সঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে নজরে এসেছে, বাঘমুণ্ডির সুইসার কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচনের ঘটনাটি। টিএমসিপি-র কাছ থেকে ওই কলেজ ছিনিয়ে নিয়েছে ছাত্র সংসদ। রাজ্য রাজনীতিতে সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়েও ছাত্র পরিষদের এই কলেজ দখলের নেপথ্যে রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহল বাঘমুণ্ডির বিধায়ক তথা কংগ্রেসের জেলা সভাপতি নেপাল মাহাতোর ভূমিকা দেখতে পাচ্ছেন। তাঁদের মতে, নেপালবাবুর প্রত্যক্ষ নজরদারিতেই ওই কলেজের ছাত্র সংসদের ক্ষমতা দখল করেছে ছাত্র পরিষদ।

উল্টো দিকে, রাজনৈতিক মহলে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে এসএফআই-এর দুর্বলতার কারণেই বিরোধী পরিসরের দখল ক্রমশই চলে যাচ্ছে এবিভিপির দিকে। ঘটনা হল ২০১২ সালে এসএফআই-র জেলা সম্মেলনের পর থেকে ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু হতে শুরু করেছে তাদের সাংগঠনিক পরিকাঠামো। ওই সম্মেলনে জেলা সম্পাদক হন সনৎ কিস্কু আর জেলা সভাপতি হন গৌরব সিংহ। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন এই দুই ছাত্র নেতার সাথে এসএফআই-র বিশেষ যোগসূত্র নেই বলে সংগঠন সূত্রে জানা যাচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে নেতৃত্বে বদল আনতে হয়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন দীপঙ্কর মাঝি এবং সভাপতির দায়িত্ব বর্তেছে গৌতম দাসের উপরে। দু’জনেই জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সম্মেলন না করেই আপাতত এই দু’জনকে সংগঠনের দায়িত্বে আনা হয়।

সংগঠনের উপরতলার টালমাটাল অবস্থার নেতিবাচক প্রভাব স্বভাবতই পড়ছে নিচুতলায়। সংগঠন সূত্রেই জানা যাচ্ছে, বিভিন্ন কলেজে প্রার্থী বাছাই করে নির্বাচনে দাঁড় করানোর যে প্রক্রিয়া বরাবর বামপন্থী ছাত্র সংগঠন নিয়ে থাকে, এ বার সেই কাজ কার্যত হয়নি। স্থানীয় ভাবে সিপিএমের নেতারা সেই চেষ্টা কিছুটা করলেও তাতে সামগ্রিক ভাবে লড়াই দেওয়া সম্ভব ছিল না। সংগঠনের এক নেতার কথায়, “শেষ জেলা সম্মেলনের কিছু পরেই সম্পাদক ও সভাপতি দু’জনেই নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। দীর্ঘদিন ধরেই জেলায় সংগঠনিক কাজকর্ম কার্যত কিছুই হয়নি। বিভিন্ন ইস্যুতে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামা-সহ কলেজ, স্কুলে আগে যে ভাবে সংগঠনের নিয়মিত কাজকর্ম করা হতো, তা প্রায় শিকেয় উঠেছে। তারই প্রভাব পড়েছে কলেজগুলির নির্বাচনে।”

২০১২ সালে রাজ্য পালাবদলের পরেও যেখানে জেলার দুই কলেজ কাশীপুর ও বরাবাজারে ছাত্র সংসদের দখল নিয়েছিল এসএফআই, এ বার কিন্তু সেই দুই কলেজেই প্রায় দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হচ্ছে এই বামপন্থী ছাত্র সংগঠনটিকে। তবে সংগঠনের জেলা সম্পাদক দীপঙ্কর মাঝি বলছেন, “কিছু কারণে সংগঠনের অন্দরে সমস্যা হওয়ায় সাংগঠনিক কাজে ভাটা পড়েছিল ঠিকই। তবে আমরা তা দ্রুত মেরামত করে নিচ্ছি। আসলে এ বার টিএমসিপির সন্ত্রাসের কারণেই কলেজগুলিতে ভাল সংখ্যায় প্রার্থী দেওয়া সম্ভব হয়নি।” আর এবিভিপি-র জেলা সভাপতি সুরজিৎ লাই বলছেন, “আগের বামফ্রন্ট সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে রাজ্যের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। এই সরকারও শিক্ষায় রাজ্যকে আরও তলানিতে পৌঁছে দিচ্ছে। এটা বুঝেই ছাত্রছাত্রীরা এবিভিপি-র প্রতি আকর্ষিত হচ্ছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ওই চারটি কলেজেও টিএমসিপি জিততে পারত না।”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE