বন্ধে সুনসান আনাড়া। বৃহস্পতিবার ছবিটি তুলেছেন পৌলমী চক্রবর্তী।
এক দিকে, এলাকার মানুষের চাপে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ। অন্য দিকে, ঘটনায় ক্রমেই লাগছে রাজনীতির রং।
সব মিলিয়ে পুলিশ হেফাজতে আনাড়ার যুবক এরিক সোরেনের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে বৃহস্পতিবারও সরগরম রইল আনাড়া। অভিযুক্ত পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের পাশাপাশি বিচারবিভাগীয় তদন্তও হবে বলে জানিয়েছেন পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীর কুমার। তিনি বলেন, “রঘুনাথপুরের এসিজেএমের (অতিরিক্ত মুখ্য বিচারবিভাগীয় বিচারক) কাছে বিচারবিভাগীয় তদন্তের জন্য আবেদন জানানো হবে।” এ ছাড়াও ঘটনার বিশদ রিপোর্ট জাতীয় ও রাজ্য মানবধিকার কমিশনের কাছে পাঠাচ্ছে জেলা পুলিশ। বুধবারই ক্লোজ করা হয়েছিল আনাড়া ফাঁড়ির ইনচার্জ, এএসআই পঙ্কজ গুপ্তকে। এ বার পাড়া থানার ওসি নীলরতন ঘোষকেও ক্লোজ করা হয়েছে। পুলিশ সুপার বলেন “ওই দু’জনকে ক্লোজ করার পরে সাসপেন্ড করা হয়েছে।”
একই সঙ্গে এরিকের মৃত্যুর ঘটনায় জড়িয়ে যাচ্ছে রাজনীতি। ঘটনার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার আনাড়ায় ১২ ঘণ্টার বন্ধ ডেকেছিল বিজেপি। আর এ দিন সেই বন্ধের বিরোধিতা করে আনাড়ায় মিছিল করল তৃণমূল। মিছিলের নেতৃত্ব দেন দলের জেলা নেতা নবেন্দু মাহালি, পাড়া পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সীমা বাউরিরা। সকালে তৃণমূলের মিছিলের ঠিক পরেই এলাকায় ফের পাল্টা মিছিল করে বিজেপি। পুলিশ মোতায়েন থাকায় দুই মিছিলকে কেন্দ্র করে সমস্যা হয়নি। দুই দলই পরস্পরের বিরুদ্ধে মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করার অভিযোগ এনেছে। পিছিয়ে নেই কংগ্রেসও। এ দিন দলের জেলা নেতা বিভাস দাসের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল মৃতের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে। রঘুনাথপুরের মহকুমাশাসকের কাছে ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত ও দোষীদের শাস্তির দাবিতে স্মারকলিপিও দেন কংগ্রেস নেতারা।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আনাড়া রেলকলোনির বাসিন্দা এরিককে চুরিতে যুক্ত থাকার সন্দেহে গ্রেফতার করেছিল পাড়া থানার পুলিশ। পরে পুলিশি হেফাজতেই মৃত্যু হয় ওই যুবকের। বুধবার ভোরে পাড়া থানার পুলিশ মৃত অবস্থায় ওই যুবককে নিয়ে গিয়েছিল রঘুনাথপুর হাসপাতালে। ঘটনার কথা চাউর হতেই বুধবার বিক্ষোভে ফেটে পড়ে জনতা। সকাল ১০টা থেকে থেকে প্রায় ১২ ঘণ্টা আনাড়ায়, পুরুলিয়া-বরাকর রাজ্য সড়ক অবরোধ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের দাবি ছিল, দোষী পুলিশকর্মীদের শাস্তি এবং মৃতর পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ ও সরকারি চাকরি। রাতে পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা দাবিগুলি নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলে অবরোধ ওঠে।
এ দিন এলাকায় গিয়ে দেখা যায় বিজেপি-র ডাকা বন্ধে ভালই সাড়া পড়েছে। দোকানপাট তো বটেই, আনাড়ার স্কুল, ব্যাঙ্কও বন্ধ ছিল। তবে, বিজেপি এই ঘটনা নিয়ে রাজনীতিু করছে, সেই অভিযোগে সকালে বন্ধের প্রতিবাদে মিছিল করে। তৃণমূল নেতা নবেন্দুবাবুর দাবি “আমরাও চাই ঘটনায় জড়িত পুলিশকর্মীরা শাস্তি পাক। উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পাক মৃতের পরিবার। আমাদের চাপেই পুলিশ-প্রশাসন কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু, পুজোর আগে এই মৃত্যু নিয়ে যেভাবে রাজনীতি করছে বিজেপি, তা মেনে নেওয়া যায় না।” বিজেপি-র জেলা সভাপতি বিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাল্টা অভিযোগ, “রাজ্য সরকারের পুলিশই থানার লক-আপে মেরেছে এরিককে। আমরা মর্মান্তিক ও অমানবিক ঘটনাটির প্রতিবাদে বন্ধ ডেকেছিলাম। কোনও জবরদস্তি করা হয়নি। মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বন্ধে সাড়া দিয়েছেন। উল্টে, তৃণমূলই বুধবার রাতে এলাকার ব্যবসায়ীদের এ দিন দোকান খোলা রাখার জন্য হুমকি দিয়েছিল।”
রাজনৈতিক চাপানউতোর যাই থাক না কেন, এলাকার সাধারণ বাসিন্দারা কিন্তু বেশি উদগ্রীব এরিকের মৃত্যুর কারণ জানতে। বুধবার ময়না-তদন্তের নথিপত্রে কিছু সমস্যা হওয়ায় ও ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত বিষয়টির নিষ্পত্তি না হওয়ায় ময়নাতদন্ত করানোর পরেও পুরুলিয়া সদর হাসপাতালের মর্গ থেকে এরিকের দেহ আনেনি তাঁর পরিবার। এ দিন অবশ্য পুলিশ উদ্যোগী হয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে দেহটি মর্গ থেকে আনাড়ায় আনে। তার আগে পুরুলিয়ায় মৃতের পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় কিছু বাসিন্দার সঙ্গে আলোচনা করেন পুলিশ সুপার।
এ দিন দুপুর ১টা নাগাদ দেহটি আনাড়ায় এরিকের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু, পুলিশকর্তাদের উপস্থিতিতেই স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ দেহে জড়ানো কাপড় খুলে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে বলে দাবি করেন। পুলিশি হেফাজতে মারধরের কারণেই মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করে দেহটি প্রায় এক ঘণ্টা আটকে রাখেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দ্যুতিমান ভট্টাচার্য-সহ পুলিশকর্তাদের হস্তক্ষেপে দেহটি আদ্রায় এনে চার্চের কাছে সমাধিস্থ করানো সম্ভব হয়েছে। তবে এরিকের মৃত্যুর কারণ নিয়ে এ দিনও স্পষ্টভাবে কিছু জানায়নি পুলিশ। পুলিশ সুপার বলেন, “ময়না-তদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পরেই এই বিষয়ে বিশদে বলা সম্ভব। আমরা চেষ্টা করছি, যাতে ময়না-তদন্তের রিপোর্ট দ্রুত পাওয়া যায়।”
পুলিশ-প্রশাসনের তরফে তিন লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ হিসাবে এ দিনই মৃতের পরিবারকে দেওয়া হয়েছে। তাই এ দিন আর অশান্তি ছড়ায়নি বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে। পুরুলিয়ার জেলাশাসক তন্ময় চক্রবর্তী বলেন, “মৃতর পরিবারকে অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার জন্য জেলা প্রশাসনের তরফে কিছু অর্থ সাহায্য করা হয়েছে। এ ছাড়াও পরিবরাটির তরফে ক্ষতিপূরণ ও চাকরির যে দাবি করা হয়েছে, তা রাজ্য সরকারের কাছে পাঠানো হচ্ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy