ভোজুডি কোলওয়াশিরার কয়েক বছর পরে চালু হয় সাঁওতালডিহি বিদ্যুৎকেন্দ্র (ডানদিকে)। চাষ জমি ও জঙ্গল বদলে যায় শহরে।—নিজস্ব চিত্র
সময়টা স্বাধীনতার এক দশক পরের। তৎকালীন বিহার অধুনা ঝাড়খণ্ডের ভোজুডিতে একটি কয়লা পরিশোধন কেন্দ্র (কোল ওয়াশারি) তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (সেল)। খবরটা কানে আসতেই সরাসরি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর কাছে ওই শিল্প এ রাজ্যকে দেওয়ার আর্জি জানান রাজ্যের সে সময়কার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। দু’জনের সখ্যতায় গোয়াই নদী পেরিয়ে ওই কোল ওয়াশারি চলে এল ঝাড়খণ্ড সীমানা ঘেঁষা সাঁওতালডিহিতে। নামটা অবশ্য রয়ে গেল সেই ‘ভোজুডি কোল ওয়াশারি’-ই। তাতেই প্রথম ভারী শিল্পের মুখ দেখল পুরুলিয়া জেলা।
কেন্দ্র যখন ভারী শিল্প দিয়েছে রাজ্যই বা কেন পিছিয়ে থাকে। ১৯৬২-তে ভোজুডি কোল ওয়াশারির কাজ শুরুর বছর পাঁচেক পরেই দেড়-দুই কিলোমিটার দূরে সাঁওতালডিহিতে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের শিলান্যাস করলেন রাজ্যের যুক্তফ্রন্ট সরকারের তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী সুশীল ধাড়া। ছ’বছর পরে সেই বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনে সাঁওতালডিহি এলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী। শুরু হল এলাকার আর্থ-সামাজিক চালচিত্র বদলের পালা।
বস্তুত সাঁওতালডিহির নাম নিয়ে এলাকায় কিছুটা বিতর্ক রয়েছে। নাম সাঁওতালডিহি হলেও এই থানার অন্তর্গত ৫৫টি গ্রামের মধ্যে একটিও সাঁওতাল অধ্যুষিত গ্রাম নেই। তাই এক পক্ষের যুক্তি, বর্তমানে যেখানে রেল স্টেশনে তার পাশেই সাতটি তালগাছ ছিল। সে কারণে ওই এলাকার নাম ছিল ‘সাততালডি’। পরে তা লোকমুখে পাল্টে হয়েগিয়েছে ‘সাঁওতালডিহি’। আবার অন্য পক্ষের বক্তব্য, বিহারের মানভূম জেলায় থাকাকালীন সময়ে পুরুলিয়ার এই অংশে সাঁওতালদের বসবাস ছিল। তখন থেকেই এলাকাটি ‘সাঁওতালডিহি’ নামেই পরিচিত। তাঁদের যুক্তি, জমির পুরানো নথিতেও বরাবরই ‘সাঁওতালডিহি’ নামেরই উল্লেখ পাওয়া যায়।
নাম-বিতর্ক যাই থাক না কেন, ৬০-৭০ দশকের পরেই দু’-দু’টো ভারী শিল্প পেয়ে একেবারে ঝাড়খণ্ড ঘেঁষা পুরুলিয়ার এই এলাকার রাতারাতি ভোল বদলে যায়। এলাকার প্রবীণরা জানাচ্ছেন, জঙ্গলে ভরা এলাকা। মাঝে কিছু চাষের জমি। বাজার করতে যেতে হত গোয়াই নদী পেরিয়ে ঝাড়খণ্ডের ভোজুডিতে। অথবা ৩০-৪০ কিলোমিটার দূরের রঘুনাথপুর বা পুরুলিয়ায়। শিক্ষা বা চিকিৎসার ক্ষেত্রেও নির্ভরতার ছবিটা কমবেশি একই। এমনই জায়গায় শুরু হল শিল্পায়নের কর্মযজ্ঞ।
ভোজুডি কয়লা পরিশোধন কেন্দ্রের জন্য অধিগ্রহণ করা হল প্রায় ৪৫০ একর জমি। এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে জমি দিলেন সাঁওতালডিহি, আগুইট্যাঁড়, নবগ্রাম, ইছড়, কামারগোড়া গ্রামের বাসিন্দারা। জমিহারা হিসেবে তাঁরা কাজ পেলেন পরিশোধন কেন্দ্র নির্মাণে। পরে কেন্দ্রীয় সরকারের স্থায়ী কর্মী হিসাবে ওয়াশারিতে কাজ পেলেন শতাধিক জমিহারা। এক দশকের মধ্যে আমূল বদলে গেল এলাকার ছবিটা। গড়ে উঠল কোল ওয়াশারির কর্মীদের টাউনশিপ। তাকে ঘিরে তৈরি হল বাজার। জমে উঠল ব্যবসা।
ভোজুডি থেকে বিভিন্ন ইস্পাতকেন্দ্র, বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা পাঠানোর জন্য লরির ব্যবসাতেও যুক্ত হলেন শতাধিক স্থানীয় যুবক। এমনকী পরিশোধন কেন্দ্রের বাতিল হওয়া কয়লাকে ঘিরেও ব্যবসা জমে ওঠে। সব মিলিয়ে কোলওয়াশারির আশপাশের পাঁচ-ছ’টি গ্রামের হাজার কয়েক পরিবারে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আসে।
এই বদলকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন কোলওয়াশারির প্রথম দিকের কর্মী তথা শ্রমিক নেতা দিলীপ মুখোপাধ্যায়। কারখানা শুরুর চার বছর পরেই ভোজুডিতে যোগ দেন তিনি। দিলীপবাবুর কথায়, ‘‘হুগলির শ্রীরামপুর থেকে এখানে কাজ করতে এসে দেখি বিস্তীর্ণ এলাকা ফাঁকা। বেশিরভাগটাই জঙ্গলে ভরা। সপ্তাহে একবার হাট বসত। সেখান থেকেই সব্জি কিনতাম। অন্য কিছু দরকার হলে ছুটতে হতো ভোজুডি বা সিন্ধ্রিতে। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই দ্রুত বদলে যায় ছবিটা। দেখতে দেখতে তৈরি হল হাসপাতাল, স্কুল, বাজার।’’ কোল ওয়াশারির টাউনশিপে দুর্গাপুজোও শুরু হয়।
এ দিকে যখন ভোজুডিকে কেন্দ্র করে ভোল বদলাচ্ছে সাঁওতালডিহির একাংশে, তখন অপর প্রান্তে শুরু হয়ে গিয়েছিল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ। কমবেশি ১৩০০ একর জমি অধিগ্রহণ শুরু করে রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ। ডাঙা জমির দাম ৭৫ পয়সা প্রতি ডেসিমিল দেওয়া হয়। তাতে বিনা বাধায় বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়তে জমি দিয়েছিলেন বগড়া, পড়াডিহা, শ্যামপুর, চকবাইদ, বেলকুঁড়া, কাঁকি, দেউলি, সিংবস্তি গ্রামের বাসিন্দারা। কারণ শিল্পায়নের হাত ধরে আর্থ-সামাজিক ছবিটা কী ভাবে বদলে যেতে পারে তার ভাল দৃষ্টান্ত তৈরি করে দিয়েছিল ভোজুডি কোল ওয়াশারি।
আক্ষরিক অর্থেই সত্তরের দশকের সাঁওতালডিহির পুরনো ছবিটা বদলে দিয়েছে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। কেস স্টাডি হিসাবে বগড়া গ্রামকে ধরা যেতে পারে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১৩০০ একরের মধ্যে প্রায় ৭০০ একর জমি দিয়েছিলেন বগড়ার বাসিন্দারা। ওই গ্রামের বাসিন্দা দিলীপ সরকার জমিহারা হিসাবে কাজে ঢুকে অবসর নিয়েছেন। তিনি শোনাচ্ছিলেন অতীতের কথা। তাঁর কথায়, ‘‘বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির কাজে ঠিকা শ্রমিক হিসেবে কয়েক হাজার মানুষ কাজ পেয়েছিলেন। বিদ্যুৎ উৎপাদনের আগে ও পরে পাঁচ-ছ’টি গ্রামের ৩৫০-র বেশি জমিহারা স্থায়ী চাকরী পান। ঠিকা শ্রমিকের কাজ পান আরও অনেকে। একলহমায় বদলে যায় আর্থ-সামাজিক চিত্র।’’ সাঁওতালডিহিতেও গড়ে ওঠে স্কুল, হাসপাতাল। কাঁচা রাস্তা বদলে যায় পিচের রাস্তায়। কুপি, লন্ঠনের বদলে ঘরে ঘরে জ্বলে ওঠে বিজলি বাতি। বগড়ার দিলীপ সরকার, পড়াডিহার ভীম মাহাতোরা বলেন, ‘‘আগে ভাল কিছু কিনতে দূরে যেতে হতো। গাড়িরও বালাই ছিল না। আর এখন থানার পাশে কাঁকি বাজারে বা টাউনশিপের সুপার মার্কেটে নামী সংস্থার শীতাতপ নিয়ন্ত্রকও মেশিনও পাওয়া যায়।’’
এলাকার আর্থিক উন্নয়ন কী ভাবে ঘটেছে তার উদাহরণ দিয়েছেন বগড়া গ্রামেই.গ্রামের উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মীরা। তাঁদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জননী ও শিশু সুরক্ষা যোজনায় এ গ্রামের প্রসূতিদের টাকা দেওয়া যায় না। কারণ গ্রামে দারিদ্র সীমার নীচে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা শূন্য।
আর গ্রামের পুরনো বাসিন্দাদের কথায়, ‘‘বিদ্যুৎকেন্দ্র শুরুর আগে গ্রামে পাকা বাড়ি ছিল না। এখন কাঁচা মাটির বাড়ির সংখ্যা হাতে গোনা।’’ শিল্পায়নের হাত ধরে সাঁওতালডিহির চিত্রটা আমূল বদলেছে।
আগে বর্ষার সময়ে বগড়ার বাসিন্দারা কাদা মাড়িয়ে যে জমিতে হালে-বলদ জুড়ে চাষ করতে নামতেন, সেই জমিতে আকাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুই চিমনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy