বিষ্ণুপুরের যৌন কর্মীদের পুজো মণ্ডপের থিম লোকশিল্প। নিজস্ব চিত্র
রাবণকাটা-নৃত্যের মুখোশ দিয়ে সাজছে যৌনকর্মীদের আয়োজিত পুজো মণ্ডপ।
দুর্বার মহিলা সমন্বয় দুর্গাৎসব কমিটি বিষ্ণুপুরের গোপলগঞ্জে এই অভিনব মণ্ডপ তৈরি করছে। এই এলাকার যৌন কর্মীদের উদ্যোগে চার বছর আগে শুরু হয়েছে দুর্গাপুজো। এ বার তাদের থিম বিষ্ণুপুরের প্রাচীন লোক উৎসব ‘রাবণকাটা নৃত্য’। রাবণ কাটা নৃত্যের চার চরিত্র বিভীষণ, সুগ্রীব, হনুমান, জাম্বুবানের ছোট বড় নানা আকারের মুখোশ দিয়ে এ বারের মণ্ডপ সাজাছেন শিল্পী সাধন দে।
বিষ্ণুপুরের দুর্বার মহিলা সমন্বয় দুর্গাৎসব কমিটির সম্পাদক পদ্মা পাত্র জানালেন, তাঁদের পল্লিতে প্রায় দেড়শো জন যৌন কর্মী রয়েছেন। সবাই মিলে চাঁদা দিয়ে তাঁরা পুজো করেন। পুরসভা থেকেও অর্থ দিয়ে সাহায্য করা হয়। স্থানীয় ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর উদয় ভকতও নানা ভাবে সাহায্য করেন। এ বার তাঁদের পুজোর বাজেট তিন লক্ষ টাকা।
কোষাধ্যক্ষ মালতি দাস, সভাপতি সঙ্গীতা ঘোষ বলেন, ‘‘বিষ্ণুপুরের রাবণ কাটা নৃত্য উৎসব লুপ্ত হতে চলেছে। হারিয়ে যেতে বসা এই লোক উৎসব পুনরুদ্ধার এবং নতুন প্রজন্মকে চেনাতেই আমাদের মণ্ডপ সজ্জার এই উদ্যোগ। সেই সঙ্গে বাচ্চাদের ভরপুর মনোরঞ্জন দেওয়াও আমাদের লক্ষ্য।’’
সম্প্রতি মণ্ডপে গিয়ে দেখা গেল শিল্পী একমনে মুখোশ তৈরির কাজ করছেন। প্রমাণ আকারের বিভীষণ, সুগ্রীব, হনুমান, জাম্বুবানের মূর্তিও তৈরি হয়েছে কিছু। শিল্পী বলেন, ‘‘ছোটবেলায় মুখোশ তৈরি করে রথের মেলায় বিক্রি করতাম। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগছে। দেড় মাস ধরে চার জন সহকারী নিয়ে টানা কাজ করছি। মূলত চট, সিমেন্ট, শন, সুতির কাপড়, পুকুরের পাঁক, আঠা ও তেল রং দিয়ে কাজটা করছি। এ বারই প্রথম মণ্ডপ সাজানোর কাজ ধরেছি। আশা করছি দর্শকদের মন জয় করতে পারব।’’ তিনি জানান, বাচ্চাগুলো তৈরির সময় থেকেই পিছু ছাড়ছে না। আর এই কাজ করে তিনি তৃপ্তও। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের শহরের পুরনো লোক উৎসব ফিরিয়ে আনার এই চেষ্টার জন্য দিদিভাইদের কুর্নিস করতে হয়। অন্য প্রতিমা তৈরি কমিয়ে এই মণ্ডপে দিন-রাত এক করে কাজ করছি।’’
কাউন্সিলর উদয় ভকত বলেন, ‘‘মণ্ডপ সজ্জার কথা শুনে প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু দিদিভাইদের উদ্দেশ জানতে পেরে যতটা পেরেছি, সাহায্য করছি। বিষ্ণুপুরের জন্য ভাবনা, বিশেষ করে পুরনো লোক শিল্পকে বাঁচানোর এই উদ্যোগ এ বছরে শহরের কোন মণ্ডপে হচ্ছে?’’ রাবণ-কাটা নৃত্য শিল্পী সুকুমার বারিক, নারায়ণ বারিক, মিঠুন লোহাররা বলেন, ‘‘শুধু দশমীর দিনেই আমরা ওই মুখোশ পরে রাবণ-কাটা নাচি। দিন দিন এই শিল্পী হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওই মুখোশ দিয়ে মণ্ডপ সাজানো হচ্ছে শুনে খুব খুশি। এতে ওই লোক শিল্প আরও জনপ্রিয় হলে, তার থেকে ভাল কিছু হয় না।’’
বিষ্ণুপুর মহকুমা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক রামশঙ্কর মণ্ডল বলেন, ‘‘যৌনকর্মীদের সম্পর্কে অনেকের ধারণা খুব উঁচু মানের নয়। তাঁদের এই লোক শিল্পকে নিয়ে ভাবা এবং বাঁচানোর উদ্যোগ অবশ্যই তারিফ যোগ্য। তাঁদের প্রস্তুতি দেখতে আমি নিজে যাব।’’ তাঁর আশ্বাস, ওঁরা যদি পুজোর ক’দিন রাবণ কাটা নৃত্যের কোনও অনুষ্ঠান করতে চান, তিনি মহকুমা তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর থেকে সব রকম সাহায্য করবেন।
এলাকার প্রবীণ যৌন কর্মীরা বলেন, ‘‘পুজোর সময় যখন অন্য মণ্ডপে ছেলেমেয়েদের নিয়ে যেতাম মুখ ঝামটা খেতাম। সেই দুঃখে চার বছর আগে অল্প আয়োজনে পুজো শুরু করি। এ বারে আমাদের মণ্ডপ দেখতে বিষ্ণুপুরবাসীই তাঁদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসবেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy