শিবের বিয়ে। মহম্মদবাজারের রায়পুরে। নিজস্ব চিত্র।
শালের বন গাঢ় সবুজ। রাঙা শিমুল, পলাশ। ফাগুন রাতে বসেছে বিয়ের বাসর। বাবা বুড়োনাথের বিয়ে। আর সেই বাসর জমজমাট মেলা।
মহম্মদবাজারের রায়পুর গ্রামের এই মেলা প্রায় একশো বছরের পুরনো। কথিত আছে, সেই সময়ে বিহারের মুঙ্গেরের বাসিন্দা শঙ্কর গোস্বামী তাজপুর মৌজায় এসে সাধনা শুরু করেন ওই এলাকা তখন ঘন জঙ্গলে ঢাকা। কিছু দিনের মধ্যেই শঙ্করবাবার নাম এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। জনশ্রুতি তিনিই শিবের বিয়ের এই প্রথা চালু করেন। শুরু হয় মেলা। সামান্য কয়েকটি দোকান। রাতে বাঘ ভালুকের ভয়ে দোকানদারেরা পাততাড়ি গুটিয়ে সাধুবাবার আশ্রমে আশ্রয় নিতেন।
দীর্ঘদিন মেলায় দায়িত্ব সামলিয়ে আসছেন বীরেন ঘোষ। তিনি বলেন, ‘‘ছোট বেলায় বাবার সাইকেলে চড়ে মেলায় যেতাম। কাঁটা ঝোপের মধ্যে দিয়ে সরু রাস্তা। তখন মেলা মানেই মাটির হাঁড়ি আর খাজা।’’ এখনও মেলার মূল আকর্ষণ মাটির বাসন। ঝড়খণ্ডের আসনবুনি থেকে গরুর গাড়িতে মাটির হাঁড়ি সাজিয়ে আসেন মহাদেব পাল, মানিক পাল, অনিল পালেরা। মিহির মণ্ডল নামে এক কুম্ভকার বলেন, ‘‘দেড়শো-দু’শো গাড়ি বাসন আনলেও মেলায় শেষ পর্যন্ত সব বিক্রি হয়ে যায়।’’
মেলার থেকেও বড় আকর্ষণ বুড়োনাথের বিয়ে। লোকগবেষক আদিত্য মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘শিবের বিয়ের প্রথা বীরভূমে সচরাচর দেখা যায় না। তবে ইটাগড়িয়ার পটুয়ারা শিবকে কৃষক রূপে কল্পনা করে কৃষি কন্যা দুর্গার সঙ্গে বিয়ের কাহিনি পটে দেখান।” চতুর্দশী শেষ হয়ে যখন অমাবস্যায় পড়ছে, তখনই আসে রায়পুরে বুড়োনাথের বিয়ের ক্ষণ। মন্দিরের পাশে ছাদনাতলা। ভক্তদের মাথায় চেপে বৃষবাহন শিব-পার্বতীর প্রাচীন বিগ্রহটি সেখানে উপস্থিত হয়। তেল-সিঁদুরে সেজে দেবী তখন গ্রামের মেয়ে। মালা বদল, লজ্জা বস্ত্র, সিঁদুরদান— সমস্ত উপাচার মেনে বিয়ের অনুষ্ঠান চলে। পৌরহিত্য করেন শঙ্কর গোস্বামীর বংশধর রাধাকান্ত গোস্বামী। বীরেনবাবু বলেন, ‘‘আমারা নিজেরাই ভাগ হয়ে বরপক্ষ আর কনেপক্ষ হই। আপায়্যনের কাজ করি।’’
বিয়ের শেষে সুগন্ধী তেল, সিঁদুর ছড়িয়ে দেওয়া হয় ভক্তদের মধ্যে। একে অন্যের হাতে মাঙ্গলিক লাল সুতো বেঁধে অনুষ্ঠান শেষ হয়। তার পরেও চলতে থাকে কোলাকুলি, মিষ্টি বিতরণ। পার্বতীকে নিয়ে শিব সাত দিন থাকেন ছাদনাতলায়। অষ্টমঙ্গলায় ভক্তদের কাঁধে চড়ে বউ নিয়ে আবার মন্দিরে ফেরা।
মাঝের ক’টা দিন নবগ্রাম, রূপগঞ্জ, ডাঞ্জনা, ভাগলপুর, গামিড়া, মহম্মবাজার, দেউচা, মুরগাবনি-সহ প্রায় ৫০টি গ্রামের মানুষ জমজমাট মেলায় ভিড় জমান। নবগ্রামের সনাতন মণ্ডল, রূপগঞ্জের সুধীর মণ্ডলরা জানান, এলাকার বাসিন্দারাই মন্দির এবং আটচালা সংস্কার করিয়েছেন। ২০০৪ সালে মেলায় বিদ্যুতের বন্দোবস্ত হয়। তবে মেলা কমিটির নারায়ণ মণ্ডলের আক্ষেপ, ‘‘প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েও পানীয় জল আর রাস্তার উন্নতি এখনও হল না।’’ তবে বিডিও (মহম্মদবাজার) তারাশঙ্কর ঘোষ পানীয় জলের ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিয়েছেন।
প্রায় হাজার দশেক লোকর পাত পেড়ে খিচুড়ি, তরকারি, টক খাওয়ার মধ্য দিয়ে মেলার শেষ হয়। চারদিনের একটানা কীর্তনের আওয়াজ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়। মাটির বাসনও থিতু হয় গৃহস্থের সংসারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy