বিদ্যাভবনের গেটের সামনে পৌঁছতেই ভেঙে গেল লাইন। হুড়মুড়িয়ে ঢোকার চেষ্টা আবেদনকারীদের। বাধা দিচ্ছে পুলিশ।
প্রাথমিকের টেট পরীক্ষা ঘিরে দুর্ভোগ ও বিশৃঙ্খলার ছবিটা বদলাল না এ বারও। গতবারও পরীক্ষার ফর্ম তোলা এবং পরীক্ষায় বসা নিয়ে রাজ্য জুড়ে চরম নাকাল হতে হয়েছিল পরীক্ষার্থীদের। এ বছরও টেটের ফর্ম তোলার সময় থেকেই সেই বিশৃঙ্খলার চেনা চিত্র। এই অবস্থাই বাঁকুড়া শহরে ঘোরালো আকার নিল বৃহস্পতিবার। পুলিশের সঙ্গে বচসায় জড়ালেন আবেদনকারীরা। দু’তরফে ধস্তাধস্তি হল। অনেক আবেদনকারী পড়ে গিয়ে চোট পেলেন। রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিলেন তাঁরা।
গোটা জেলায় কেবল মাত্র জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের দফতর বিদ্যাভবনেই এই পরীক্ষার আবেদনপত্র বিলি হচ্ছে। ফলে জেলার নানা প্রান্ত থেকে ভ্যাপসা গরমের মধ্যেই বাঁকুড়া শহরে ছুটে আসছেন হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থী। লম্বা লাইন পড়ছে শহরের পথে। ফর্ম বিলি শুরু হলে কে কত তাড়াতাড়ি তা সংগ্রহ করতে পারে, তা নিয়ে চলছে হুড়োহুড়ি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড়িয়ে কেউ মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছেন, কেউ গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। কেউ এক দিনে আবেদন পত্র তুলতে না পেরে রাতভর শহরে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সব মিলিয়ে চরম নাজেহাল অবস্থায় পড়তে হচ্ছে আবেদনকারীদের। বিদ্যাভবনে মোট ন’টি কাউন্টার খুলে ছেলে ও মেয়েদের ফর্ম দেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়ানো আবেদনকারীদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে বিদ্যাভবনের দরজার সামনে আসার পরেই। সেখানে লাইন বলে আর কিছুই কার্যত থাকছে না। হুড়োহুড়ির মধ্যে কে আগে ঢুকে কাউন্টারে যেতে পারে তার প্রতিযোগিতা শুরু হচ্ছে।
বৃহস্পতিবারও ছবিটা এক ছিল। সকাল থেকে টেট-এর ফর্ম তুলতে আসা প্রার্থীদের লাইন পড়েছিল বিদ্যাভবন থেকে কয়েক কিলোমিটার দূর পর্যন্ত। বিশৃঙ্খলা সামাল দিতেই বাঁকুড়া পুলিশের রিজার্ভ পুলিশের দল বিদ্যাভবনের সামনে মোতায়েন করা হয়েছিল। কিন্তু উর্দিধারীদের দেখেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এর পরেই পুলিশ বলপ্রয়োগের ভয় দেখায় পরিস্থিতি সামাল দিতে। আর তাতেই বাধে গোলমাল। পুলিশকে লাঠি উঁচিয়ে আসতে দেখে দৌড়তে শুরু করেন লাইনে দাঁড়ানো পুরুষ-মহিলারা। পরিস্থিতি কার্যত হাতের বাইরে বেরিয়ে যায়। বিদ্যাভবনে ঢোকার দরজার সামনে পাথরের উপরে পড়ে যান এক মহিলা আবেদনকারী। হাত কেটে রক্ত ঝরতে থাকে তাঁর। মহিলা পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে চিকিৎসা করান। পুলিশের ভয়ে ছুটতে গিয়ে এক দল যুবক মাঝরাস্তায় এসে পড়লে শুরু হয় যানজট।
বুধবার রোদের হাত থেকে বাঁচতে মাথায় ধরতে হয়েছিল ছাতা। বৃহস্পতিবার বৃষ্টিতেও ভরসা সেই ছাতা।
এ দিনও পুরুলিয়ায় প্রাথমিকে টেটের ফর্ম তুলতে ভোগান্তির শিকার হতে হল। ছবি: সুজিত মাহাতো
এর পরেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন আবেদনকারীরা। তাঁদের ক্ষোভ, “চাকরি দেব বলে রাজ্য সরকার পরীক্ষার আয়োজন করছে। কিন্তু, আবেদনকারীদের সমস্যার কথা একবারও ভাবেনি। না হলে জেলার আরও নানা জায়গা থেকে আবেদনপত্র বিলি করার ব্যবস্থা করত।’’ তালড্যাংরার হাড়মাসড়ার বাসিন্দা শুভজিৎ হাজরা জানান, আবেদন পত্র তুলতে বুধবার তিনি বাঁকুড়ায় এসেছিলেন। দিনভর লাইনে দাঁড়িয়েও আবেদনপত্র পাননি। বাড়িও ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। কোনও মতে একরাতের জন্য ভাড়া দিয়ে এক ব্যক্তির বাড়িতে মাথা গুঁজেছিলেন। এ দিন সকাল থেকে ফের লাইনে দাঁড়িয়ে কোনও মতে ফর্ম পেয়েছেন। তাঁর কথায়, “ভ্যাপসা গরমে নাজেহাল অবস্থা। অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ভিড়ের মধ্যে মহিলারা আরও সমস্যায় পড়ছেন।’’ তিনি জানান, পুলিশ তেড়ে আসতেই তাঁর মতো অনেকে ভয় পেয়ে দৌড়েছিলেন। অনেকেই পড়ে গিয়ে জখম হয়েছেন। ওন্দা থেকে আবেদনপত্র তুলতে আসা সুকুমার গায়েন এ দিন ফর্ম তুলতে পারেননি। তাঁর ক্ষোভ, “এ ভাবে না দিয়ে অনলাইনেও তো ফর্ম বিলি করা যেতে পারত। কুকুর বিড়ালের মতো পুলিশ আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে গেল! সারা দিন কিছু খাওয়া হয়নি। শেষে আবেদনপত্রও পেলাম না। রাজ্য সরকার কবে সব দিক ভেবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিতে শিখবে?’’ বাবার সঙ্গে কোতুলপুর থেকে আবেদনপত্র তুলতে এসেছিলেন স্নেহা দাস। বিকেলের শেষ বেলায় কোনও মতে ফর্ম তুলতে পেরেছেন তিনি। কিন্তু কী ভাবে বাড়ি ফিরবেন, তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তাঁর ক্ষোভ, “আমার জন্য বাবাকেও ভোগান্তি পোহাতে হল। এক প্রকার যুদ্ধ করেই ফর্ম হাতে পেয়েছি। কিন্তু, বাড়ি ফেরার বাস নেই। কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না।’’
পড়ে গিয়ে চোট পেলেন এক মহিলা। ছবি: অভিজিৎ সিংহ।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান রিঙ্কু বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আবেদনপত্র সংগ্রহ করতে আসা চাকরি প্রার্থীদের লম্বা লাইন পড়ছে। এ দিন বিশৃঙ্খলা সামলাতেই পুলিশ পদক্ষেপ করেছিল। ভিড়ের মধ্যে এক বধূ পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছেন বলে শুনেছি।’’ তিনি জানান, আজ শুক্রবার থেকে আবেদনকারীদের লাইন যাতে ঠিকমতো থাকে, তার জন্য ব্যারিকেড গড়া হবে বিদ্যাভবনে। তাঁর বক্তব্য, “রাজ্য আমাদের যে ভাবে আবেদনপত্র বিলি করার নির্দেশ দিয়েছে, আমরা সেভাবেই কাজ করছি।’’ জেলার এক পুলিশকর্তার দাবি, পুলিশ চাকরিপ্রার্থীদের দিকে তেড়ে যায়নি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে একটু গলা উঁচিয়ে কথা বলেছিল।
এখনও পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার আবেদনকারী ফর্ম তুলেছেন বলে বিদ্যাভবন সূত্রে জানা গিয়েছে। আগামী শনিবার পর্যন্ত ফর্ম দেওয়া চলবে বলেই নির্দেশ এসেছে রাজ্য থেকে। আবেদনপত্র তোলার হিড়িক দেখে গতবারের টেট-এর তুলনা টানছে শিক্ষামহল। এ বার পরীক্ষার দিন পরিবহণে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে, নাকি গতবারের মতোই হয়রানি হবে, এই প্রশ্নও উঠছে বিভিন্ন মহলে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy