দেরিতে হলেও নড়ল টনক।
ভাড়া ঘরে রমরমিয়ে চলছিল অস্ত্র তৈরির কারখানা। হানা দিয়ে কাজ-কারবার দেখে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন পুলিশ কর্তারা। এখানেই শেষ নয়। ওই ঘটনার কয়েক বছরের মধ্যে ফের অন্য একটি ভাড়া ঘরে মজুত রাখা নিষিদ্ধ শব্দবাজি ফেটে হুলস্থূল কাণ্ড বাধে। পর-পর শহরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে এমন কাণ্ড বাধানোয় এ বার নড়েচড়ে বসেছে রঘুনাথপুর পুরসভা। পুলিশের সঙ্গে আলোচনা করে এই শহরের ভাড়াটেদের তালিকা-সহ ‘ইনফর্মেশন ব্যাঙ্ক’ তৈরি করার কাজে নেমে পড়েছে রঘুনাথপুর পুরসভা।
ভাড়াটেদের বিশদ বিবরণ সংগ্রহের জন্য ফর্ম ছাপিয়ে বাড়ির মালিকদের দেওয়া হচ্ছে। তা পূরণ করে বাড়ির মালিকেরা নিজেরাই, কিংবা কাউন্সিলরদের মাধ্যমে পুরসভায় জমা করছেন। ওই ফর্মের একটি ফটোকপি জমা করা হচ্ছে থানায়।
পুরসভা সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই ভাড়াটেদের সম্পর্কে তথ্য সম্বলিত একশোর কিছু বেশি ফর্ম জমা পড়েছে। তবে এই শহরে ভাড়াটের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। পুরপ্রধান ভবেশ চট্টোপাধ্যায় মানছেন, ‘‘অনেক বাড়ির মালিকই পুরসভার সঙ্গে সহযোগিতা করছেন না। ভাড়াটের সম্পর্কে তথ্য দিতে গড়িমসি করছেন তাঁরা।’’ তিনি জানান, বাড়ি মালিকেরা সহযোগিতা না করলে, এ বার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছে পুরসভা।
বস্তুত, ২০০৯ সালে রঘুনাথপুর মহকুমা এলাকায় শিল্পায়নের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই এই মহকুমা সদরে বাড়ি ভাড়ার ব্যবসা রমরমিয়ে শুরু হয়। ভিন্ জেলা তো বটেই, ভিন্ রাজ্য থেকেও অনেকে এই শহরে নানা কাজের সূত্রে আসেন। এখনও পর্যন্ত শিল্পের পালে হাওয়া ততটা না লাগায় ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা মন্দা চলছে। কিন্তু তাতেও ভাড়াটের সংখ্যা কম নয়। অথচ অধিকাংশ ভাড়াটের সম্পর্কে পুলিশ বা পুরসভার কাছে কোনও তথ্য নেই। কখনও কিছু গোলমাল হলে, তখনই এ নিয়ে কিছুদিন হইচই হয়। তারপরে যে কে সেই।
গত বছর রঘুনাথপুর শহরের ব্লকডাঙা এলাকায় একটি ভাড়া বাড়িতে হানা দিয়ে পুলিশের চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার জোগাড়। ভাড়াবাড়িতে লেদ মেশিন বসিয়ে অস্ত্রের খোল তৈরির কারখানা ফেঁদে বসেছিল ঝাড়খণ্ডের দুষ্কৃতীরা। উদ্ধার হয় কিছু আগ্নেয়াস্ত্রের খোল, মেশিনপত্র। সেখানে কয়েকমাস ধরে অস্ত্র তৈরির কারখানা চলছিল। অথচ পড়শিরা এর বিন্দু-বিসর্গ কিছুই জানতেন না বলে জানিয়েছেন। পুরসভা জানত, সেখানে লেদ বসিয়ে সাধারণ যন্ত্রাংশ তৈরির কাজ হয়। কারণ সেই কাজের জন্যই লাইসেন্স নেওয়া হয়েছিল।
পরের বছরে এই শহরেরই একটি ভাড়া বাড়িতে রাখা বিস্ফোরণের শব্দের পরে আগুন লাগে। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, সেখানে মজুত করা নিষিদ্ধ শব্দবাজি ফেটেই ওই কাণ্ড। অথচ সেখানে যে এমন বেআইনি কাণ্ড চলছে, পুলিশ-প্রশাসন তার কিছুই জানত না। তখনই তৎকালীন এসডিপিও (রঘুনাথপুর) অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ভাড়াটেদের তালিকা ও তাঁদের সম্পর্কে ‘তথ্য-ব্যাঙ্ক’ তৈরির জন্য পুরসভাকে পরামর্শ দেয়।
এর পরেই পুরসভা ধাপে ধাপে কয়েকটি কাজ করেছে। পুরসভা সূত্রে খবর, প্রথমে এই তথ্য দেওয়া কেন জরুরি, শহরের বাড়ি মালিকদের তা বোঝাতে প্রচার চালানো হয়। দ্বিতীয়ত প্রতিটি কাউন্সিলরকে ওই ছাপানো ফর্ম দিয়ে নিজেদের ওয়ার্ডের বাড়ি মালিকদের তা দিতে বলা হয়। ভাড়াটেদের সম্পর্কে বিশদে তথ্য পেতে ফর্মে ভাড়াটের নাম, ছবি-সহ তাদের ভোটার কার্ড ও আধার কার্ডের নম্বর, ভাড়াটের মূল বাড়ি কোথায়, তিনি কী কারণে রঘুনাথপুরে আছেন, তাদের কাজের বিশদ বিবরণের মতো মোট ১৩টি বিষয় জানতে চাওয়া হয়েছে।
পুরপ্রধান বলেন, ‘‘শহর ক্রমশ বাড়ছে। কাজের সূত্রে বহু বহিরাগত রঘুনাথপুরে বাড়ি ভাড়ায় নিয়ে বাস করছেন। কাজেই তাঁদের সম্পর্কে বিশদ তথ্য সংগ্রহ করে রাখার দরকার।’’ জেলা পুলিশের এক কর্তাও জানান, পুরসভার পাশপাশি পূরণ করা ওই ফর্ম থানাতেও জমা রাখা হচ্ছে। পুলিশের আশা, যে ভাবে বিশদ তথ্য ও বিরবণ সংগ্রহ করা হচ্ছে, তাতে পরবর্তী সময়ে ভাড়া বাড়িতে কোনও অপরাধ ঘটলে ভাড়াটের সম্পর্কে সহজেই তথ্য পাওয়া যাবে। ওই পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় ভাড়াটে সম্পর্কে বিশদে না জেনেই বাড়ি ভাড়া দিয়েছেন মালিকরা। ফলে তদন্তে সমস্যা হয়। বাড়ি মালিকও বিব্রত হন। এই তথ্য দেওয়া থাকলে সবার পক্ষেই সুবিধা।”
তা হলে কিছু বাড়ি মালিক কেন ভাড়াটের তথ্য দিতে গড়িমসি করছেন? কয়েকজন বাড়ি মালিকের বক্তব্য, পুরসভাকে না জানিয়ে তাঁরা বাড়ি ভাড়া দিচ্ছেন। পুরসভা খবর পেলে করের বোঝা বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই ওই তথ্য দিতে তাঁরা আগুপিছু ভাবছেন। পুরপ্রধান বলেন, ‘‘আমাদের কাছে খবর আছে এই শহরে প্রায় ৩০০ বাড়ি মালিক ভাড়া দিচ্ছেন। নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই ওই তথ্য তাঁদের দেওয়া দরকার। সহযোগিতা না করলে তাঁদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy