দর্শনার্থীদের ভিড়। —নিজস্ব চিত্র।
নোট বদলের চোটে বাজার এখনও সরগরম। ডাকঘর-ব্যাঙ্কে লাইন। একশো, পাঁচশোর নোট প্রায় অমিল এটিএমে। পকেটে দু’হাজারের নোট থাকলেও, খুচরোর আকাল! কিন্তু সে সবের যেন কোনও প্রভাবই পড়ল না তারাপীঠের কার্তিক পুজোয়। নবান্ন উপলক্ষে মঙ্গলবার তা প্রায় জাঁকজমক পূর্ণ পুজোয় পরিণত হয়। নোটের আকালেও সেই আয়োজনের কোনও খামতি দেখা যায়নি। ছবিটা মোটের উপর একই মহম্মদবাজারেও। মৌমাছি ক্লাবের উদ্যোগে সেখানে দেওয়া হল সম্প্রীতির বার্তা।
আগে নবান্ন উপলক্ষে কার্তিক পুজো মূলত মা তারার মূল মন্দির লাগোয়া এলাকায় আলাদা জায়গায় হত। সেই জায়গায় তৈরি হয়েছে পৃথক ভাবে কার্তিক পুজোর জন্য পাকা দালানের মণ্ডপ। যেটা এলাকায় ‘কার্তিক মঞ্চ’ নামে পরিচিত। তারাপীঠ এলাকায় কার্তিক পুজোর প্রচলন এখান থেকেই নানা জায়গায় ছড়িয়ে যায়। তারাপীঠের বাসিন্দা তথা তারামাতা সেবাইত সমিতির কোষাধ্যক্ষ শ্যামল মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মূল মন্দির সংলগ্ন কার্তিক মঞ্চে তারাপীঠ মিলন সঙ্ঘর পরিচালনায় পুজো হয়ে থাকে। এই পুজোর জন্য ক্লাবের সদস্যদের নিয়ে আলাদা করে কমিটি গঠন করা হয়।” তিনি জানান, আগে কার্তিক ঠাকুরের মূর্তির সঙ্গে জয়া বিজয়ার মূর্তি তৈরি হত। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে কার্তিক মূর্তির পাশাপাশি ষাঁড়ের উপরে শিবমূর্তি, যুদ্ধরত অসুর মূর্তি গড়ে তোলা হয়।
এলাকার বাসিন্দা সুশান্ত চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বর্তমানে তারাপীঠ এলাকায় মন্দির সংলগ্ন কার্তিক মঞ্চ ছাড়া সব্জি বাজার, পাল পাড়া, লেটপাড়া ও রবীন্দ্রপল্লি— সব মিলিয়ে পাঁচ জায়গায় কার্তিক পুজো হয়। ঘটনা হল, তারাপীঠ এলাকায় নবান্ন উৎসব ঘিরে কার্তিক পুজোর উদ্বোধন সোমবার সন্ধ্যাতেই করেছেন মন্ত্রী তথা তারাপীঠ রামপুরহাট উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়।
মঙ্গলবার দুপুরে এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, তারাপীঠ এলাকায় অনেক বাড়িতেও বাড়িতেও বড় মাপের কার্তিক ঠাকুর গড়ে পুজা করা হয়েছে।
বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া রবীন্দ্রপল্লি উন্নয়ন সমিতি এ বছর কার্তিক পুজোয় তাদের মণ্ডপ দিল্লির পার্লামেন্ট হাউসের আদলে তৈরি করেছে। মণ্ডপের ভিতর বিশালাকারের কার্তিক অসুরের সঙ্গে যুদ্ধে রত। প্রতিটি পুজো ঘিরেই জাঁকও নজরে পড়ে। কার্তিক পুজো ঘিরে তারাপীঠের ভিতর দিয়ে যাওয়া রামপুরহাট– সাঁইথিয়া পাকা সড়কের উপর চোখে পড়ে আলোকসজ্জার গেট করা হয়েছে। তারাসাগর পাড়ে একটি ছোট মেলাও বসেছে। নোটের আকাল চললেও তারাপীঠে কার্তিক পুজোর জাঁকজমকে কোনও খামতি নেই।
এলাকার সাংস্কৃতিক কর্মী গুরুশরণ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আগামী পাঁচ দিন নানান রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মেতে থাকবে তারাপীঠ।’’ কার্তিক পুজোর উদ্যোক্তারা জানালেন, ‘‘নবান্নে কার্তিক পুজোর প্রস্তুতি সারাবছর ধরে নেওয়া হয়। খুচরো নোট সমস্যায় কিছুটা সমস্যা হলেও দ্রুত সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবেন সকলে।’’ নবান্নে ধুমের ছবি, দেউচা অঞ্চলের রঘুনাথপুর গ্রামেও। বিভিন্ন ধর্মের মানুষ একসঙ্গে নবান্ন করেন এ দিন। বাসিন্দাদের দাবি, ‘‘স্থানীয় মৌমাছি ক্লাবের উদ্যোগেই সম্প্রীতির এই বিরল দৃষ্টান্ত ও মহামিলন সম্ভব হয়েছে।’’
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, মৌমাছি ক্লাবের সদস্যরা বছর পনেরো আগে বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেয়, গ্রামের সকলে এক সঙ্গে নবান্ন উৎসব পালন করার।
সেই থেকে জাতধর্ম নির্বিশেষে গ্রামের সকলে মিলে একসঙ্গে নবান্ন করেন। নবান্ন উপলক্ষে নিজেরাই যাত্রা করেন। তার প্রস্তুতি শুরু হয় মাস তিনেক আগে থেকে। এ বারে নবান্নের দিন হয় মঙ্গলবার। গ্রামের অধিকাংশ লোকজন এ দিন সকাল থেকে কাজকর্ম ছেড়ে খাওয়া দাওয়া আর যাত্রা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। এ দিন রাত্রেই মঞ্চস্থ হবে একটি সামাজিক যাত্রাপালা। স্থানীয় জগৎ বন্ধু সাহা, দেবদাস সাহা, মহম্মদ অলিউল, আবুতৌহিদ শেখ, বিকাশচন্দ্র সাহা, আনন্দ সাহা, ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠরত সৈফুল আলমরা জানান, সংস্কৃতি ও ঐক্যের মেলবন্ধনের গ্রাম। মৌমাছি ক্লাবের উদ্যোগে সেই ধারাকে গ্রামবাসী আরও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
ক্লাবের সভাপতি খাইরুল হোসেন ও সম্পাদক তথা স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য কৃষ্ণকান্ত সাহা বলেন, ‘‘পারস্পরিক সম্প্রীতি বজায় রাখতেই নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়।’’
জানা গেল, গ্রামের মেয়ে ও গৃহবধূ অবিলা বেগম ও পায়েল সাহা যাত্রা শুরুর আগে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উপর বক্তব্য রাখবেন। এ দিন সকাল থেকে দুধ, খীর, কলা, মুলো, আপেল-সহ নানা ফল ও চিনি মাখানো চাল গুড়ির সিন্নি ও নতুন গোবিন্দ ভোগ চালের পায়েস দিয়ে নবান্নের খাওয়া শুরু হয়। রাতেও যাত্রা শেষে অনেক বাড়িতেই একসঙ্গে পাত পেড়ে খাবেন। এই নোটের আকালে খরচ করে নবান্নে ধুম! প্রশ্ন করার আগেই গ্রামের এক প্রৌঢ় জানালেন, ‘‘এ সমস্যা হয়তো দু’চার দিনেই মিটে যাবে। কিন্তু নবান্নের এমন দিন তো আর ফিরবে না! সারা বছর ধরে এই দিনটার জন্য আমরা অপেক্ষা করে থাকি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy