প্রথমবার ভোট জিতেই পুরপ্রধান হয়েছিলেন। পরের বার বিরোধী দলনেত্রী। আর এ বার দলের টিকিটই পেলেন না শিউলি মিদ্যা!
আসন্ন পুর-নির্বাচনে বাঁকুড়া পুরসভায় বামফ্রন্টের প্রার্থী তালিকা থেকে বাদ পড়ল প্রাক্তন পুরপ্রধান শিউলিদেবীর নাম। দীর্ঘ দশ বছর তিনি শহরের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম কাউন্সিলর ছিলেন। ২০০৫ সালে প্রথমবার ভোটে জেতার পরেই দল তাঁকে পুরপ্রধান করে। ২০১০ সালের পুরভোটে ক্ষমতায় হারায় বামফ্রন্ট। শিউলিদেবীকে বিরোধী দলনেত্রীর জায়গা দেয়। যদিও জেলা সিপিএমের একাংশে একাধিকবার অভিযোগ উঠেছে, বিরোধিতার জায়গায় শিউলিদেবীকে খুব একটা দেখা যায়নি। বিশেষ করে যেখানে, গত পাঁচ বছরে তৃণমূল পরিচালিত বাঁকুড়া পুরসভায় নানা বিষয় নিয়ে বিতর্ক বেঁধেছে। সে জনবহুল মাচানতলা মোড়ে পূর্ত দফতরের অনুমতি ছাড়া মুক্তমঞ্চ গড়াই হোক বা সময়ের আগেই বাঁকুড়া পুরসভার সার্ধশতবর্ষ পূর্তি। অথবা বিগত আড়াই বছর ধরে চেয়ারম্যান ইন কাউন্সিল ছাড়াই পুরসভা চালানো হোক বা শহরে অসম উন্নয়নের অভিযোগ। এর পাশাপাশি রয়েছে শাসকদলের বিরুদ্ধে স্বজনপোষণের অভিযোগ।
অথচ কোনও কিছু নিয়েই সে ভাবে সরব হতে দেখা যায়নি পুরসভার মূল বিরোধী বামফ্রন্টকে।
মূলত, সেটাই শিউলিদেবীকে এ বার টিকিট না দেওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ বলে সিপিএম সূত্রের খবর। শিউলিদেবীর সঙ্গে এ বার টিকিট পাননি সিপিএমের আর এক মহিলা কাউন্সিলর পুতুল লোহার। জেলা সিপিএমের এক নেতার কথায়, “গত পাঁচ বছরে বাঁকুড়া পুরসভায় দলীয় ভাবে কী আন্দোলন করা হয়েছে, সে প্রশ্ন করলে আমরা অস্বস্তির মুখে পড়ি। কারণ, আমাদের বিরোধী দলনেত্রীর নেতৃত্বে তৃণমূলের পুরবোর্ডের বিরুদ্ধে সে ভাবে সরবই হননি!” ঘটনাও হল, সিপিএমের তুলনায় বিদায়ী পুরপ্রধান শম্পা দরিপার বিরুদ্ধে বেশি গলা ফাটিয়েছেন তৃণমূলেরই উপ-পুরপ্রধান অলকা সেন মজুমদার। কংগ্রেসের কাউন্সিলরদের সঙ্গে তিনি অনাস্থা পর্যন্ত আনেন শম্পাদেবীর বিরুদ্ধে। আস্থাভোটে পরাজিত হয়েও দলের হস্তক্ষেপে পুরপ্রধানের কুর্সি বেঁচে যায় শম্পাদেবীর। বরং চেয়ারম্যান-ইন-কাউন্সিল (সিআইসি) ভেঙে দেওয়ায় উপ-পুরপ্রধানের চেয়ার হারান অলকাদেবীই। দলের প্রতি অভিমানে বিগত প্রায় আড়াই বছর পুরসভার চৌকাঠ মাড়াতে দেখা যায়নি তাঁকে। এর পর থেকে নিজের মতো করে পুরসভা চালিয়েছেন শম্পাদেবী। তাঁর কাজকর্ম নিয়ে পুরসভার বাইরে একাধিক বার প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু, কী কংগ্রেস, কী বামফ্রন্টবিরোধীরা কেউ পুরসভার ভিতরে গলা ফাটাননি তাঁর বিরুদ্ধে।
গত বছর জুলাই মাস থেকে বাঁকুড়া পুরসভার ২২ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম কাউন্সিলর স্বরূপ সেনের হাত ধরে কয়েকটি বিষয় নিয়ে আন্দোলনে নামেন বাম কাউন্সিলরেরা। সিপিএম সূত্রের খবর, পুরসভায় বিরোধী দলনেত্রী পদটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে বুঝে তীব্র ভাবে না হলেও বাম কাউন্সিলরদের সঙ্গে এ বার গলা মেলান শিউলি মিদ্যাও। ততদিনে অবশ্য দল যারপরনাই অসন্তুষ্ট তাঁর উপরে। বরং বাঁকুড়া পুরসভায় আন্দোলন গড়ে তুলে শিউলিদেবীকে ছাপিয়ে দলের নজর কেড়েছেন স্বরূপবাবু। পুরভোটের একেবারে মুখে যখন পাঁচ বছরের গাড়ির বিল এক সঙ্গে অনুমোদনের আবেদন জানান শম্পা দরিপা, তখন বামেদের একজোট হয়ে সরব হতে দেখা যায়। তখন থেকেই শিউলিদেবী সুর চড়ানো শুরু করেছিলেন শম্পাদেবীর বিরুদ্ধে। তাতেও দলের আস্থা যে তিনি ফিরে পাননি, তা স্পষ্ট হয়ে গেল প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পরেই। যে তালিকায় স্বরূপ সেনের নাম থাকলেও বাদ পড়ল শিউলিদেবীর নাম! সিপিএম সূত্রে খবর, দলের মধ্যে রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ দে-র অনুগামী ছিলেন শিউলিদেবী। বয়সের কারণে পার্টি থেকে অবসর নিয়েছেন পার্থবাবু। তাই শিউলিদেবীকে টিকিট না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে খুব একটা চিন্তায় হয়নি দলের নেতৃত্বকে।
শিউলিকে প্রার্থী না করার পিছনে দল অবশ্য প্রকাশ্যে অন্য যুক্তি দেখাচ্ছে। সিপিএমের বাঁকুড়া জোনাল কমিটির সম্পাদক প্রতীপ মুখোপাধ্যায় বলেন, “এ বার ন’জন মহিলাকে প্রার্থী করা হয়েছে। তাঁদের হয়ে প্রচারে অভিজ্ঞ মহিলাকর্মী দরকার। তাই দীর্ঘদিন ধরে জনপ্রতিনিধি হিসেবে কাজ করা শিউলিকে আমরা প্রচারে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” শিউলিদেবীকে এ দিন বারবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। জবাব দেননি এসএমএসের-ও।
বস্তুত, পালাবদলের পর থেকেই গোটা রাজ্যের মতো বাঁকুড়াতেও একের পর এক নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছে বামেদের। নিচুতলার কর্মী ও নেতাদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনে ভোট প্রাপ্তির নিরিখে বাঁকুড়া পুরসভায় দ্বিতীয় স্থান থেকে তৃতীয়তে নেমে গিয়েছে বামেরা। উঠে এসেছে বিজেপি। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আগামী পুরভোটে বামেরা কতটা ফিরে আসতে পারে, সেটাই দেখার। প্রতীপবাবুর অবশ্য দাবি, “লোকসভা ভোটে বিজেপি একটা ফ্যাকটর ছিল। এখন আর নেই। তাই, এ বার লড়াই হবে তৃণমূলের সঙ্গে সিপিএমের। বাঁকুড়ার মানুষ এটা বুঝেছেন, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জেরবার তৃণমূল পুরসভা চালাতে পারবে না। তাই তাঁদের কাছে বিকল্প হয়ে ওঠার লড়াইয়ে এগিয়ে আমরাই।” আর এই দিকটি বিচার করেই এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা খতিয়ে দেখে এ বার বেশ কয়েক জন কমবয়সীকে প্রার্থী করেছে সিপিএম তথা বামফ্রন্ট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy