প্রত্যন্ত গ্রামে পুজোর উপকরণ জোগাড় করে নির্বিঘ্নে পুজো সারা কম হ্যাপার নয়। দায়িত্বের বোঝা সামলে পুজোয় আনন্দ করার অবকাশ মেলে না বললেই হয়। আনন্দের খামতি মেটাতে এবং পুরনো বন্ধুদের সঙ্গ পেতে তাই পুজো কমিটির কর্তারা শতাব্দী কাল আগে বিজয়ার পরের দিন মন্দির চত্বরে মেলার প্রচলন করেছিলেন। স্থানীয় ভাষায় ‘বাসি বিজয়ার মেলা’। বুধবার সেই বাসি বিজয়ার মেলায় মাতল বোরো থানার আগুইবিল গ্রামের বাসিন্দারা। শুধু তাঁরাই নয়, আশপাশের এলাকা থেকেও বহু মানুষ মেলায় এসেছিলেন।
প্রবীণরা জানাচ্ছেন, আগুইবিল গ্রামে আগে পুজো ছিল না।
স্মৃতি হাতড়ে তাঁরা জানান, স্থানীয় জমিদার নরসিংহ মাহাতো এই পুজো বান্দোয়ানের শ্যামনগরে চালু করেছিলেন। এই গ্রামটিও তাঁর জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ছিল। সে সময় ঘন জঙ্গলের মাঝখানে মন্দির চত্বরে মাঝে মধ্যে বাঘ, ভালুক হামলা চালাত। বন্য জন্তুদের আক্রমণের আশঙ্কায় মন্দিরে লোকজন তেমন আসতেন না। কোনওক্রমে পুজো সারা হতো। তবে পুজো কমিটির কর্তারা, পুজো বন্ধ করার কথা ভাবতে পারেননি। পুজো টিকিয়ে রাখতে কয়েক বছর পরে মন্দির ও মেলা সরিয়ে আনা হয় বোরো থানার আগুইবিল গ্রামে। সেই থেকে মন্দির চত্বরে বিজয়ার পরের দিন মেলা হয়ে আসছে।
বোরো এবং বান্দোয়ান থানার দুর্জয়পাড়া, ঘুসিকজোড়া, জয়পুর, হাতিরামগোড়া, কৃষ্ণপুর, শ্যামনগর, রাধানগর প্রভৃতি প্রায় ২০-২২টি গ্রামের বাসিন্দা মেলায় আসেন। সকাল থেকে মেলা শুরু হয়। মেলা ভাঙতে রাত গড়িয়ে যায়। এ বারও তাই হল। মেলায় এসে অনেকেই পুরনো বন্ধুদের নিয়ে গল্পে মশগুল হয়ে পড়েন।
আগুইবিল গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা হরিপদ সিং সর্দার, অতুল মাহাতো বলেন, ‘‘কয়েক দশক আগেও স্থানীয় বাসিন্দারা যাত্রাপালায় অভিনয় করতেন। দু’মাস ধরে মহড়া চলত। তারপর পালা মঞ্চস্থ হয়। সে এক অন্যরকম দিন ছিল।’’
হরিপদবাবু-অতুলবাবুদের মুখে যুবক বেলার স্মৃতির আলো। বাসিন্দাদের একাংশ স্বীকার করেন, পালা মঞ্চস্থ করার খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রায় দেড় দশক হল যাত্রাপালা হয় না। তবে কয়েক দশক আগে কে কোন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তা নিয়ে এখনও প্রবীণ বাসিন্দারা চর্চায় মশগুল হয়ে পড়েন।
শ্যামনগর গ্রামের অচিন্ত্য মাহাতো, দুর্জয়পাড়া গ্রামের অনিল মাহাতো, কৃষ্ণপুর গ্রামের হরিপদ হেমব্রমদের বয়স সত্তরের আশেপাশে। তাঁরা সকলেই বয়সের বাধা উপেক্ষা করে বাসি বিজয়ার মেলায় এসেছেন। এই বয়সেও মেলায়? তাঁরা জানান, কিশোর বয়স থেকে বাসি বিজয়ার মেলায় আসছেন। তখন ছেলেবেলার দুরন্তপনা ছিল। আর এখন মেলায় তাঁরা আসেন পুরনো বন্ধুদের খোঁজে। দেখা মিললে মেলা চত্বরেই আড্ডা চলে। সেই আড্ডা বিকেল অবধি গড়াতে পারে।
হাতিরামগোড়ার বাসিন্দা অজিত মাহাতো বলেন, ‘‘এমনিতে বছরের বাকি সময়ে কারও সাথে তেমন একটা দেখা হয়ে ওঠে না। আমার হাঁটুতে বাতের ব্যাথা। তাই নাতির সাইকেলে চড়ে এসেছি।’’
রাধানগরের বাসিন্দা কমলাকান্ত মাহাতো জানান, বেশ কয়েক বছর ধরে বাড়ির বাইরে তাঁরও তেমন একটা যাতায়াত নেই। তবে এ দিন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে বলে তিনি মেলায় এসেছেন। আড্ডার মাঝে মুখ ভার করে বলেন, ‘‘বাড়ি ফেরার জন্য নাতি তাড়া দেয়। না হলে আরও কিছুক্ষন বসা যেত। এই আড্ডা ছেড়ে উঠতে মন চায় না।’’
আসলে বাসি বিজয়ার মেলায় এসে তাঁরা সবাই বয়সের গণ্ডি ডিঙিয়ে কিশোর-যুবা বয়সের স্মৃতিতে ডুব দিয়ে বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে নিয়ে যান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy