নিহত হীরেন মণ্ডলের ছবি হাতে মা।
এক জন প্রাণ দিয়েছিলেন জখম সহযোদ্ধাকে বাঁচাতে গিয়ে। দেশের সীমান্তরক্ষায় গিয়ে জঙ্গিদের ছুটে আসা গুলিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন দ্বিতীয় জন।
কয়েক দশক পরে বুধবার বীরভূমের সেই দুই বীর শহিদ জওয়ান সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় এবং হীরেন মণ্ডলকেই স্মরণ করল বিএসএফ। এ দিন নানুর এবং খয়রাশোলের পাঁচড়ায় নিহত দুই জওয়ানের স্কুলে বিএসএফ-এর অফিসার এবং স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনের উপস্থিতিতে ওই অনুষ্ঠান হয়। দুই অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিএসএফ-এর বহরমপুর ডিআইজি হেড কোয়ার্টারের প্রতিনিধি সাব-ইনস্পেক্টর সুব্রত সাহা এবং তরুণকুমার দাস বলেন, ‘‘আগে কর্তব্যরত অবস্থায় সিআরপি, পুলিশ বা বিএসএফ জওয়ানের মৃত্যু হলে শহিদের মর্যাদা পেতেন না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বার থেকে সেই ব্যবস্থা করছেন। কর্তব্যরত অবস্থায় যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি সম্মান জানাতে জওয়ানদের স্কুলে আগামী ২১ অক্টোবর দেশজুড়ে শোক সম্মেলন ও শহিদ স্মরণ দিবস পালিত হবে।’’ পাশাপাশি স্কুলগুলিতে শহিদ জওয়ানদের নামে একটি ক্লাসঘর উৎসর্গ করা এবং একটি প্রতিকৃতি বানিয়ে দেওয়ার কথাও রয়েছে বলে তাঁরা জানান। নির্ধারিত দিনে রাজ্যের স্কুলগুলিতে পুজোর ছুটি পড়ে যাওয়ায় মঙ্গলবার এই অনুষ্ঠান হল।
নানুরে নিহত সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়কে স্মরণ। —নিজস্ব চিত্র
বিএসএফ-এর ১১৬ নম্বর ব্যাটেলিয়ানের জওয়ান সঞ্জীবের বাবা নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন প্রাক্তন সেনা কর্মী। আদতে নানুরের কড়েয়া গ্রামে বাড়ি হলেও নন্দদুলালবাবুরা দীর্ঘদিন ধরেই কীর্ণাহারের বাসিন্দা। ২০০১ সালে বাহিনীতে যোগ দেন সঞ্জীব। ২০০৪ সালের ৯ মে কাশ্মীরের ডোডা জেলার বাঁদিপুরে ফ্ল্যাগমার্চ চলাকালীন গুলি চালায় জঙ্গিরা। তাতে এক শিশুর মৃত্যু হয়। প্রকাশ ঝাঁ নামে এক জওয়ানের গায়ে গুলি লাগে। আহত সঙ্গীকে তুলে আনতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন সঞ্জীবও। ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। সেই খবর কীর্ণাহারে পৌঁছতেই গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হন সঞ্জীবের প্রেমিকা স্থানীয় এক তরুণী। ছেলের মৃতদেহ আঁকড়ে সঞ্জীবের মা মায়াদেবী বলেছিলেন, ‘‘আমার তো আর ছেলে নেই। একটাই মেয়ে। না হলে তাকেও দেশের কাজে পাঠাতাম।’’ এ দিন ছেলের ছবি বুকে চেপে নন্দদুলালবাবুও বলেন, ‘‘আমরা ফৌজি। দেশের জন্য প্রাণদান আমাদের কাছে গর্বের। তাই ছেলের জন্য আমি গর্বিত।’’ এ দিন সঞ্জীবের স্মৃতিতে শ্রদ্ধা জানতে নানুর হাইস্কুলে আসেন বিএসএফ-এর প্রতিনিধিরা। ওই স্কুল থেকেই ১৯৯৯ সালে মাধ্যমিক পাশ করে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন সঞ্জীব। কিন্তু আর পড়া হয়নি। ভর্তি হওয়ার পরেই বিএসএফ-এ যোগ দেন।
অন্য দিকে, ১৯৯১ সালের ২৮ জুন পাকিস্তানের প্রায় গা ঘেঁষে থাকা পঞ্জাবের ফিরোজপুর জেলার আমনেওয়ালিতে কর্তব্য পালন করছিলেন বিএসএফ-এর এক সাব ইনস্পেক্টর-সহ সাত জওয়ান। সীমান্ত পেরিয়ে আসা সন্ত্রাসবাদীরা আচমকা হামলা চালিয়ে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল সাত জনকেই। তাঁদেরই এক জন ছিলেন খয়রাশোলের চাপলা গ্রামের বছর একুশের হীরেন। পঁচিশ বছর পরে সেই শহিদ সৈনিকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এ দিন তাঁর ছোটবেলার স্কুল পাঁচড়া হাইস্কুলকে বেছে নেয় বিএসএফ। ঘটনার সময় ছোট ছেলের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন মা প্রিয়বালা মণ্ডল। এখনও ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। চলাফেরা করতে পারেন না। বিএসএফ-এর ডাকে শহিদ জওয়ান হীরেনের দিদি রেখা এবং তাঁর দুই দাদা ধীরেন ও নীরেন মণ্ডলরা মাকে নিয়ে এসেছিলেন স্কুলে। ছেলের একটা বড় ছবি ধরে স্থবির হয়ে বসেছিলেন প্রিয়বালাদেবী। রেখা বলেন, ‘‘ভাইয়ের শোকেই মা এমন হয়ে গিয়েছেন। ভাইয়ের স্মৃতির জন্য এখানে ডাকা হয়েছে বুঝলেও তা প্রকাশ করার ক্ষমতা মায়ের নেই। আমাদের সান্ত্বনা, পঁচিশ বছর পরে হলেও শহিদের সম্মান জানানো হল ভাইকে।’’ এ দিন দুই স্কুলেই সকালের ওই স্মরণ অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন সমস্ত পড়ুয়া, শিক্ষক এবং বাসিন্দারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy