Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

বন্ধ এটিএম, ভরসা সেই ব্যাঙ্কই

নোট বাতিলের পরে শুক্রবার প্রথম বিভিন্ন ব্যাঙ্কের এটিএম খোলার কথা ছিল। কিন্তু কিছু এটিএম খুললেও বীরভূমের গ্রাহকেরা যথেষ্ট পরিষেবা পেলেন না। এ দিকে পাঁচশো এবং হাজার টাকার পুরনো নোট বাতিলের তিন দিন পরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার প্রভাবের নানা নতুন নজির উঠে এল। জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে সেই সুলুক সন্ধান করল আনন্দবাজার।নোট বাতিলের পরে প্রথম ব্যাঙ্ক খুলতেই লম্বা লাইন প়ড়েছিল বৃহস্পতিবার। শুক্রবার কথা ছিল এটিএম খোলার। খুলল বটে, তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই যন্ত্রে ভরা টাকা ফুরিয়ে গেল কর্পূরের মতো।

দুর্ভোগের ছবি। আশায় আশায়। শান্তিনিকেতনে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক চত্বরের বন্ধ এটিএম-এর সামনে লাইন।

দুর্ভোগের ছবি। আশায় আশায়। শান্তিনিকেতনে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক চত্বরের বন্ধ এটিএম-এর সামনে লাইন।

কিংশুক আইচ
শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৫৩
Share: Save:

থেকেও নেই

নোট বাতিলের পরে প্রথম ব্যাঙ্ক খুলতেই লম্বা লাইন প়ড়েছিল বৃহস্পতিবার। শুক্রবার কথা ছিল এটিএম খোলার। খুলল বটে, তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই যন্ত্রে ভরা টাকা ফুরিয়ে গেল কর্পূরের মতো। বীরভূমের লিড ব্যাঙ্ক ম্যানেজার দীপ্তেন্দ্রনারায়ণ ঠাকুর জানান, জেলায় রাষ্ট্রায়ত্ত এবং গ্রামীণ মিলিয়ে ১৮৮টি ব্যাঙ্ক রয়েছে। এটিএম রয়েছে ১২১টি। ব্যাঙ্কের কাছাকাছি যে এটিএমগুলি রয়েছে সেখানে ১০০ টাকার নোট ভরে দেওয়া হয়েছে। আর প্রত্যন্ত এলাকার? সে বিষয়ে সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। আরও কয়েক দিন না গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না বলেই মত অনেকের। কিন্তু বাদবাকি অধিংকাশ এটিএমই বন্ধ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘নতুন নোট জেলায় এলেও প্রযুক্তিগত সমস্যার জন্য এটিএম পরিষেবা স্বাভাবিক করা যাচ্ছে না।’’

শুক্রবার সকাল ৯টার মধ্যেই রামপুরহাট শহরের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখা লাগোয়া এটিএমের সমস্ত টাকা ফুরিয়ে যায়। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা রামপুরহাট চালধোয়ানী পাড়ার পাথর ব্যবসায়ী শঙ্কর সেনগুপ্ত মাঝপথে এটিএমে টাকা ফুরিয়ে যাওয়ায় ব্যাঙ্কের কাউন্টারের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু তাড়া থাকায় এ দিন খালি হাতেই লাইন ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হয় তাঁকে। বেলা গড়াতেই টাকা ফুরিয়ে যায় বোলপুর এবং শান্তিনিকেতন এলাকার একাধিক ব্যাঙ্ক এবং ডাকঘরে। ই-কাউন্টার খুললে টাকা জমা দেওয়ার যে সুবিধা হতে পারে ভেবেছিলেন গ্রাহকদের একাংশ। কিন্তু এ দিনও তাঁদের কাছে ব্যাঙ্কের লাইন ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা খোলা ছিল না।

সমস্যা হয়েছে ডাকঘরেও। মুরারইয়ের বাসিন্দা জগন্নাথসেবা দত্ত জানান, মাসখানেক ধরে ওই এলাকার ডাকঘর থেকে পরিসেবা মিলছে না। এই পরিস্থিতিতেও ‘লিঙ্ক ফেল’ থেকেছে সেখানে।

খাজনা দিতে

অচল টাকা নিয়ে যখন গেরস্থ ঝঞ্ঝাটে, বোলপুর পুরসভার তখন পৌষমাস। দীর্ঘদিনের বকেয়া করের টাকা ম্যাজিকের মতো জমা পড়তে শুরু করেছে। বাড়ির কর, দোকানের ভাড়া, ট্রেড লাইসেন্স রিনিউ, প্ল্যান পাস-সহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসায়ী এবং গৃহস্থদের থেকে বেশ কয়েক লক্ষ টাকা পাওয়ার কথা পুরসভার। কিন্তু এত দিন ছুতোয় নাতায় সেই দায় এড়িয়েছেন অনেকেই। পুরকর্মীরা দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। লাভ হয়নি।

শুক্রবার থেকে কোনও চাপাচাপি ছাড়াই বানের জলের মতো বকেয়া টাকা জমা পড়তে শুরু করেছে পুর-তহবিলে। তবে পুরোটাই পাঁচশো আর হাজার টাকার নোটে। পুরসভার অ্যাকাউন্ট বিভাগের কর্মী গোপাল ভট্টাচার্য জানান, পুরসভা খোলার ঘণ্টা খানেকের মধ্যে প্রায় ১ লক্ষ ২৯ হাজার টাকার বকেয়া জমা পড়েছে।

বাজার থেকে কর আদায় করেন পুরকর্মী সমীর দত্ত মুদি। তিনি জানান, এত দিন বকেয়া আদায়ে গেলে অনেকেই ফিরিয়ে দিতেন। অজুহাত দিতেন, বিক্রিবাটা নেই, খাজনা দেব কীসে! সমীরবাবু জানান, শুক্রবার বোলপুর সুপার মার্কেট বা জামবুনি বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া বাজারে যেতেই অধিকাংশ দোকানদার এক কথায় টাকা দিয়ে দিয়েছেন। এতদিন যাঁরা চুপ করে বসেছিলেন, তাঁদের অনেকেই নিজের গরজে পুরসভার কাউন্টারে গিয়ে পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে আসছেন। আট নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা এ দিন বকেয়া এগারো হাজার টাকা করের মধ্যে ছ’হাজার টাকা মিটিয়েছেন হাজার টাকার পুরনো নোটে। তিনি বলেন, ‘‘কোনও না কোনও দিন দিতে তো হতোই। অচল নোটগুলো এই বাজারে চালিয়ে দিলাম। ব্যাঙ্কে লাইন দেওয়ার হ্যাপাটাও কমল।’’

বোলপুরের পুরপ্রধান সুশান্ত ভকত বলেন, ‘‘নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত আমরা পুরনো নোট নেব।’’ বিদ্যুতের বিল মেটানোয় পুরনো পাঁচশো এবং হাজার টাকা ব্যবহার করার সুযোগ থাকায় এ দিন স্বস্তি মিলেছে বোলপুর এলাকার গ্রাহকদের একাংশেরও।

ক্লান্ত হয়ে লাইনের মধ্যেই বসে পড়লেন এক মহিলা। সাঁইথিয়ার একটি ব্যাঙ্কের সামনে।

চাষ কী ভাবে

বেকায়দায় পড়েছেন চাষিরাও। এখন স্বর্ণধান কেটে আলু লাগানোর সময়। দু’টি চাষ মিলিয়ে প্রয়োজন প্রচুর দিনমজুর। তাঁদের কাজে নিলে পয়সা দেবেন কী করে? সেই চিন্তায় ঘুম উবেছে চাষিদের। সেই ভাবনা বহু গুণে বেড়েছে যাঁদের ধান কেটে আলু লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। এঁদের বাড়তি চিন্তা সার কিনবেন কী করে? দু’টি ক্ষেত্রেই তো প্রয়োজন কাঁচা টাকার। সেই টাকা আসবে কোথা থেকে? এখন তো আর কেউ জেনে-বুঝে ১০০০ ও ৫০০ টাকার নোট নিতে চাইবেন না! তা হলে?

উত্তর নেই কৃষি দফতরের কাছেও। কৃষি দফতরের কর্তারা মানছেন, এই সময়টা চাষিদের কাছে খুবই মূল্যবান। এক দিকে ধান কেটে ঘরে তোলা। অন্য দিকে, রবিশষ্য বিশেষ করে আলুর চাষ। দুটি ক্ষেত্রেই প্রচুর দিনমজুর লাগে। এক কর্তার কথায়, ‘‘নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ধান কাটতে কিংবা আলু লাগাতে না পারলে ফলনও কম হবে।’’

সাঁইথিয়া, ময়ূরেশ্বর এলাকার চাষি মাঠপলসার শেখ কালাম, মাজিগ্রামের প্রণব মুখোপাধ্যায়, সাউলডিহির জয়ন্তকুমার সাহা, বৈদ্যপুরের অধর পাল, হরিসরার শিবানন্দ রায়, রাঢ়কেন্দ্রের প্রভাত মণ্ডল, বুঁইচার তরুণী মণ্ডল, মল্লারপুরের জহর রায়েরা বলছেন, ‘‘হাতে টাকা রয়েছে। অথচ টাকার অভাবেই চাষ মার খাচ্ছে। চেয়ে চেয়ে শুধু দেখছি। করতে পারছি না কিছুই।’’ সমস্যার কথা মানছেন জেলা কৃষি আধিকারিক সমীর ঘোষ। তবে তিনি মনে করেন, ‘‘টাকা বাতিলের সমস্যা সাময়িক। ব্যাঙ্কগুলি যে তৎপরতার সঙ্গে কাজ করছে তাতে আশা করা যায় খুব দ্রুত সমস্যা মিটে যাবে।’’

অপেক্ষা। রামপুরহাটে একটি ব্যাঙ্কের সামনে মোটরবাইকের লাইন।

বৃন্দাবনে বিপত্তি

ভেবেছিলেন বৃন্দাবনে গেলে সমস্ত সমস্যা মিটে যাবে। মেটেনি।

অক্টোবরের ২৭ তারিখ রামপুরহাট শহর এবং মহকুমার মল্লারপুর, নলহাটি, আয়াষ প্রভৃতি এলাকার মোট ১৮০ জন পর্যটককে উত্তর ভারত ভ্রমণে নিয়ে গিয়েছিলেন অর্ধেন্দু দাস। মঙ্গলবার যখন নোট বাতিলের ঘোষণা হয় তাঁরা তখন পুষ্করে। পর্যটক সোমনাথ দে জানান, তাঁদের হাতে যে টাকা ছিল তার মধ্যে বেশির ভাগই পাঁচশো আর হাজার টাকার নোটে। বৃন্দাবনের কোনও ব্যাঙ্কে গিয়ে নোট বদল করে বাকিটা অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করে ফেলবেন ভেবেছিলেন। অভিযোগ, লম্বা লাইন ঠেলে পৌঁছনোর পরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কাউন্টারে বসা কর্মী জানান, স্থানীয় অ্যাকাউন্ট না হলে টাকা বদল বা জমা করা যাবে না। অর্ধেন্দুবাবুর দাবি, প্রয়োজনীয় নথিপত্র থাকা সত্বেও বেশ কয়েকটি ব্যাঙ্ক ওই পর্যটকদের ফিরিয়ে দিয়েছেন। শুক্রবার এটিএম চালু হওয়ার পরেও ওই পর্যটকেরা বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। বিদেশ বিভুঁইয়ে এ রকম ফাঁপড়ে প়ড়ে তাঁরা অবশেষে শরণ নিয়েছেন স্থানীয় পাণ্ডাদের। অর্ধেন্দুবাবু জানান, থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত করার জন্য পাণ্ডাদের হাতে থোক পনেরো হাজার টাকা তুলে দিয়েছেন তাঁরা।

রামপুরহাটের বিভিন্ন ব্যাঙ্কের কর্মীরা এ হেন ঘটনার কথা শুনে অবশ্য অবাক হয়ে যাচ্ছেন। শহরের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘পরিচয়পত্র থাকলে দেশের যে কোনও ব্যাঙ্কেই নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা জমা বা বদল করা যাচ্ছে। এমনটা হওয়ার কথা না।’’

তথ্য: অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়, ভাস্করজ্যোতি মজুমদার, দয়াল সেনগুপ্ত, মহেন্দ্র জেনা ও অর্ঘ্য ঘোষ।

শুক্রবার ছবিগুলি তুলেছেন বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী, অনির্বাণ সেন এবং সব্যসাচী ইসলাম।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE