Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

মোবাইল ফোনে জুড়বে মাওবাদী এলাকা

২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর। আযোধ্যা পাহাড়ের হিলটপে পিএইচই-র বাংলোয় রাত কাটানোর কথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। চারিদিকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা। সন্ধ্যার মুখে কনভয় মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে পাহাড়ের মাথায় পৌঁছল। কিন্তু চারপাশের অন্ধকার পরিবেশ, মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক উধাও দেখেই সেখানে রাত কাটানোর ইচ্ছা সঙ্গে সঙ্গেই বাতিল হয়ে যায়। মুখ্যমন্ত্রী নেমে আসেন পাহাড়ের নীচে পুরুলিয়া পাম্প স্টোরেজ প্রকল্পের বাংলোয়। সেখানেই তিনি রাত কাটান।

সমীর দত্ত
বান্দোয়ান শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০৮
Share: Save:

২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর। আযোধ্যা পাহাড়ের হিলটপে পিএইচই-র বাংলোয় রাত কাটানোর কথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। চারিদিকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা। সন্ধ্যার মুখে কনভয় মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে পাহাড়ের মাথায় পৌঁছল। কিন্তু চারপাশের অন্ধকার পরিবেশ, মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক উধাও দেখেই সেখানে রাত কাটানোর ইচ্ছা সঙ্গে সঙ্গেই বাতিল হয়ে যায়। মুখ্যমন্ত্রী নেমে আসেন পাহাড়ের নীচে পুরুলিয়া পাম্প স্টোরেজ প্রকল্পের বাংলোয়। সেখানেই তিনি রাত কাটান।

২০০৫-র ডিসেম্বর। বান্দোয়ানে সিপিএম নেতা রবীন্দ্রনাথ করকে মাওবাদীরা বাড়ির মধ্যে সস্ত্রীক গুলি চালিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারে। সে বছরেই স্থানীয় দুলুকডি গ্রামে সিপিএম নেতা মহেন্দ্র মাহাতো মাওবাদী হামলায় নিহত হন। এমন অনেক নাশকতায় কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ কাছে পিঠে থাকলেও বিপদের আশঙ্কায় যেমন তড়িঘড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারেনি, তেমনই মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক না থাকায় পুলিশের কাছেও খবর এসেছে দেরিতে।

২০০৫-২০১৩ জঙ্গলমহলের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি বিশেষ হয়নি। তাই এ বার জঙ্গলমহলের কোথায় কোথায় মোবাইল পরিষেবার হাল কেমন, তা জানতে সংশ্লিষ্ট বিডিওদের কাছে বিশদে রিপোর্ট তলব করেছেন পুরুলিয়ার জেলাশাসক তন্ময় চক্রবর্তী। তিনি বলেন, “এই জেলার জঙ্গলমহলের অনেক এলাকায় মোবাইলের টাওয়ার পাওয়া যায় না। কোন কোন এলাকা নেটওয়ার্কের বাইরে থেকে যাচ্ছে মানচিত্র-সহ সেই সব এলাকার বিস্তারিত রিপোর্ট বিডিওদের চাওয়া হয়েছে। সেই সব এলাকায় সরকারি কোনও ভবন থাকলে সেখানে মোবাইলের টাওয়ার বসানোর সুবিধা রয়েছে কি না, তাও খোঁজ করতে বলা হয়েছে।” তিনি জানান, এই রিপোর্ট রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের কাছে পাঠানো হবে। তিনি বলেন, “মনে হয় রিপোর্ট পাঠানোর পর একসময়কার মাওবাদী প্রভাবিত এলাকায় শীঘ্র মোবাইল টাওয়ার বসানোর কাজ শুরু করা হবে।”

পুরুলিয়া জেলার মাওবাদী উপদ্রুত ৯টি থানা হল: বোরো, বান্দোয়ান, বলরামপুর, বাঘমুণ্ডি, আড়শা, জয়পুর, কোটশিলা, ঝালদা, বরাবাজার। ওই থানা এলাকায় আংশিক ভাবে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। কিন্তু অধিকাংশ এলাকায় আবার নেটওয়ার্ক নেই। আবার ঝাড়খণ্ড ঘেঁষা কিছু এলাকায় ঝাড়খণ্ডের মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়।

এরফলে পুলিশের সমস্যা বেশি। প্রশাসনিক কাজেও সমস্যা কম নয়। জেলা পুলিশের এক কর্তার কথায়, “আগে মাওবাদী নাশকতার পরে অনেক সময় মোবাইলের নেটওয়ার্ক না থাকায় পুলিশের কাছে খবর আসতে দেরি হয়েছে। এমনকী ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া এলাকায় সন্দেহভাজন দলের গতিবিধি নজরে এলেও বাসিন্দাদের কাছ থেকে পুলিশে খবর আসতে আসতেই তারা উধাও হয়ে গিয়েছে। জেলার বিভিন্ন থানার পুলিশ কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, অযোধ্যাপাহাড়েও সমস্যা রয়েছে। বিস্তীর্ণ এলাকায় বিএসএনএল কাজ করে না। তারমধ্যে অল্প কিছু এলাকায় ভরসা বেসরকারি নেটওয়ার্ক। তবে অধিকাংশ জায়গাতেই কোনও নেটওয়ার্ক নেই। ঝালদা ও কোটশিলার বিস্তীর্ণ এলাকাতেও একই ছবি।

বান্দোয়ান বাজার এলাকায় কিছু ল্যান্ড ফোন রয়েছে। এলাকার বাকি এলাকায় ল্যান্ড ফোন সে ভাবে নেই। বান্দোয়ান বাজারের আশপাশের কয়েক শুধু কিলোমিটারে মোবাইল পরিষেবা পাওয়া যায়। এক পদস্থ পুলিশ কর্তার মতে, মাওবাদীরা অতীতে এই এলাকায় মোবাইল পরিষেবার উন্নতি না হওয়ার সুযোগ নিয়ে অনেক অপকর্ম ঘটিয়েছে। এখনও নতুন করে মাওবাদীদের গতিবিধি ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া এলাকায় নজরে এসেছে পুলিশের। তাই স্বস্তিতে নেই পুলিশ-বাহিনী।

বলরামপুর, বান্দোয়ান-সহ পুরুলিয়ার মাওবাদী প্রভাবিত বেশিরভাগ জায়গাই জঙ্গল ও পাহাড় ঘেরা। কিছু কিছু জায়গায় বেসরকারি মোবাইল সংস্থা মোবাইলের টাওয়ার বসালেও পরিষেবার মান বিশেষ বাড়েনি। সংস্থার কর্তাদের ব্যাখ্যা, এই এলাকায় গভীর জঙ্গল ও উঁচু পাহাড় থাকায় তরঙ্গ বাধা পায়। ফলে নেটওয়ার্কের আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে কিছু এলাকা। এক একটি টাওয়ার বসানোর জন্য প্রচুর খরচ হয়। কিন্তু ভৌগোলিক সমস্যার জন্য বেশি এলাকায় তরঙ্গ না পৌঁছনোয় সংস্থাগুলির পক্ষে জঙ্গলমহলে টেলিকম ব্যবসা তেমনটা লাভজনক নয়। আবার এই এলাকায় মোবাইল টাওয়ার রাখার ঝুঁকিও যে একেবারেই নেই, তাও নয়।

জেলাশাসকের নির্দেশ পেয়ে বিডিও-রা থানার ওসিদের সঙ্গে সাহায্য নিয়ে ওই রির্পোট তৈরি করছেন। কেউ কেউ ইতিমধ্যে রিপোর্ট পাঠিয়েও দিয়েছেন। বান্দোয়ানের ওসি সুদীপ হাজরা বলেন, “বান্দোয়ানের ৮টি অঞ্চলের মধ্যে ধাদকা, কুমড়া, কুচিয়া এলাকায় কোনও সংস্থার মোবাইল কাজ করে না। এ ছাড়া বান্দোয়ান ও চিরুডি অঞ্চল আংশিক ভাবে মোবাইল পরিষেবার বাইরে। আবার এমন কিছু কিছু এলাকা আছে যেখানে ঝাড়খণ্ডে মোবাইল সংস্থার নেটওয়ার্ক আসে। সে কারণে ওই এলাকায় ‘রোমিং’ বাবদ ফোনের খরচও বেশি। আমরা এই সব এলাকা চিহ্নিত করে জেলায় রিপোর্ট পাঠিয়েছি।” বরাবাজারের বিডিও অনিমেষকান্তি মান্না জানান, তাঁর ব্লকে ছ’টি এলাকা তাঁরা চিহ্নিত করে জেলাশাসকের দফতরে জানিয়েছেন। ওই ‘শ্যাডো জোন’ এলাকায় কোনও সংস্থার মোবাইল কাজ করে না। কোটশিলা থানার ওসি সৌরাংশু রায় বলেন, “এই থানা এলাকায় এমন কিছু এলাকা আছে যেখানে টাওয়ারের তরঙ্গ অনেক কম। আবার অনেক সময় তাও মেলে না। এতে কাজের খুব অসুবিধা হচ্ছে। এলাকা পরিদর্শন করে আমরা ওই সব জায়গা চিহ্নিত করেছি।”

শুধু কি পুলিশের অসুবিধা?

ফোন পরিষেবা না থাকায় এখনও নির্বাচনের সময় দ্রুত তথ্য আদান প্রদানের জন্য বিডিওরা আলাদা করে মোটরবাইক ম্যাসেঞ্জার রাখেন। অথবা ফোন পরিষেবা পাওয়া যায়, এমন জায়গায় গিয়ে ভোটকর্মীদের ফোনের মাধ্যমে তথ্য দেওয়ার নির্দেশ দেন। দীর্ঘদিন ধরে এই নিয়ম চলে আসছে। প্রত্যন্ত এলাকায় পঞ্চায়েতগুলিও টেলি পরিষেবার অভাবে বেজায় সমস্যায় পড়েছে। ইদানীং সমস্ত পঞ্চায়েতেই বিভিন্ন প্রকল্পের রিপোর্ট ইন্টারনেটের মাধ্যমে দৈনিক ‘আপ-টু-ডেট’ করতে বলা হচ্ছে। কিন্তু জঙ্গলমহলের প্রচুর পঞ্চায়েতে এখনও ইন্টারনেট সংযোগ নেই। ফলে কাজও ব্যাহত হচ্ছে। জেলা পরিষদের সভাধিপতি নিজেও বলরামপুরের বাসিন্দা। তাঁর অভিজ্ঞতা, “টেলি পরিষেবা ভালো না হওয়ায় জঙ্গলমহলের বহু পঞ্চায়েতে ইন্টারনেট পরিষেবা দেওয়া যাচ্ছে না। এতে উন্নয়নমূলক কাজের খুব অসুবিধা হচ্ছে। ওই সব এলাকা মোবাইল পরিষেবার আওতায় এলে প্রশাসনিক কাজের খুবই সুবিধা হবে। এ দাবি আমাদের দীর্ঘদিনের।” একই সঙ্গে এর সুফল সাধারণ বাসিন্দারাও পাবেন। তার প্রভাব পড়বে জনজীবনে। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়বে।

পুরুলিয়ায় বিএসএনএলের মোবাইল পরিষেবার দায়িত্বে থাকা টেলিকম ডিস্ট্রিক্ট ম্যানেজার গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, “জঙ্গলমহলের এলাকায় মোবাইল পরিষেবা সম্পর্কে সম্প্রতি জেলাশাসকের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে ৪০টির উপর জায়গায় মোবাইলের টাওয়ার বসানোর কথা চলছে। পুর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পেলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।” তিনি জানান, দরকারে কেন্দ্র সরকারের ভতুর্কি নিয়ে ওই সব এলাকায় টাওয়ার বসানো হবে।

সহ প্রতিবেদন: প্রশান্ত পাল

স্বরাষ্ট্র দফতরে গেল বাঁকুড়ার টাওয়ার-তথ্য

নিজস্ব সংবাদদাতা • খাতড়া

বাঁকুড়া জেলার বেশ কিছু এলাকায় মোবাইলের টাওয়ার মেলে না। সম্প্রতি রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর থেকে সেই সব এলাকার নাম, মানচিত্র চেয়ে পাঠানো হয়েছে জেলা প্রশাসনের কাছে। সেই এলাকার নাম ও মানচিত্র জেলা প্রশাসনের তরফে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, জেলার যে সব এলাকায় মোবাইলের টাওয়ার পাওয়া যায় না তারমধ্যে রয়েছে বেশিরভাগই জঙ্গলমহল এলাকায়। বাঁকুড়ার জেলাশাসক বিজয়ভারতী বুধবার বলেন, “বিএসএনএল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেই যে সব এলাকায় মোবাইল টাওয়ার নেই তার তালিকা পাঠানো হয়েছে। জোন অনুযায়ী জেলার ২৭ টি এলাকা মোবাইল টাওয়ার এখন পর্যন্ত পৌঁছয়নি। ওই এলাকাগুলি সংস্থার কাছে শ্যাডো জোন। তার মধ্যে অধিকাংশই জঙ্গলমহলের রানিবাঁধ, রাইপুর, সারেঙ্গা, সিমলাপাল ব্লক এলাকায়।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE