জলের অপেক্ষায়। এমনই হাল সিউড়ি পুরসভার। ফাইল চিত্র।
একে ঘোষণার আট বছর পরেও শেষ হয়নি কয়েক কোটি টাকার জলপ্রকল্পের কাজ। তার উপর লেগেছে দুর্নীতির অভিযোগ। বিক্ষোভ-অনশন করে এ নিয়ে দলীয় কাউন্সিলরেরা আগেই বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। এ বার চিঠি লিখে দলের বিধায়কও নালিশ ঠুকেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে।
অসম্পূর্ণ কাজ আর দুর্নীতি এই জোড়া চাপেই তৃণমূল নেতৃত্বকে বেকায়দায় ফেলেছে সিউড়ি পুরসভা। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূলের সঙ্কট আরও বাড়িয়ে ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে বিজেপি-ও। গত লোকসভা ভোটের ফলাফলের নিরিখে শহরের ১৮টির মধ্যেই ১৫টি ওয়ার্ডই যাদের হাতে চলে এসেছে। রাজনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা, তৃণমূলের এই পিছিয়ে পড়ার মূলে রয়েছে জলপ্রকল্প নিয়ে বর্তমান পুরবোর্ডের ব্যাখ্যা। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব মানুষের এই ক্ষোভ দূর করতে না পারলে আসন্ন পুরভোট যে তৃণমূলের ভালই ‘ব্যথা’ বাড়াবে, তা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে দলেরই অন্দরে।
দলের জেলা নেতৃত্ব অবশ্য বরাবরই সিউড়ির পুরপ্রধানের পাশে দাঁড়িয়েছে। বৃহস্পতিবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। শুক্রবার ফের দুর্নীতির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন সিউড়ির তৃণমূল পুরপ্রধান উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়ও। উল্টে, তাঁর দৃষ্টিতে প্রকল্পের ৮৫ শতাংশ কাজই সমাপ্ত হয়ে গিয়েছে। যদিও তা মানতে নারাজ দলেরই বিধায়ক স্বপনকান্তি ঘোষ। সিউড়ির বিধায়কের অভিযোগ, “শহরের মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর দলের হাতে পুরসভার ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু, ঘটনা হল আট বছর কেটে গেলেও সিউড়ির মানুষের নিত্যদিনের জলের সমস্যা দূর হয়নি। জলের মতো মানুষের একটি ন্যূনতম চাহিদাই পূরণ করা গেল না।” তিনি আরও বলেন, “এলাকার বিধায়ক হিসেবে আমি দায় এড়াতে পারি না। তাই গত আড়াই বছর ধরেই এ বিষয়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে জানিয়েছে। কিন্তু, কোনও লাভ হয়নি। তাই বাধ্য হয়েই দলনেত্রীকে চিঠি দিয়েছি। প্রয়োজন পড়লে সিউড়ির সাধারণ মানুষের জন্য উচ্চ আদালতেও যাব।”
ঘটনা হল, দলেরই একাংশের বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন এই বিধায়ক। তাঁর দাবি, জল প্রকল্প এবং বস্তি উন্নয়ন প্রকল্পে কেন্দ্রীয় অনুদানের প্রায় ১০ কোটি ৩৬ লক্ষ টাকা সিউড়ি পুরসভা থেকে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীকে লেখার আগে দলীয় স্তরে কেলেঙ্কারির কথা জানিয়েও যে বিশেষ লাভ হয়নি, তা নিয়েও ক্ষোভ চেপে রাখেননি বিধায়ক। চিঠিতে তিনি জানিয়েছেন, গরমিলের কথা আঁচ করে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এবং স্টেট আরবান ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি-র (সুডা) কাছে অন্তত ৫টি চিঠি লিখেছিলেন। একটিরও জবাব পাননি। অথচ ২০১৩ সালেই ঢাকঢোল পিটিয়ে উদ্বোধন করে দেওয়া হয়েছে জলপ্রকল্পের। তবে, ‘বিদ্রোহী’ কাউন্সিলরদের থেকে চিঠি পেয়ে অস্বস্তি এড়াতে ঘোষণার পরেও উদ্বোধনে আসেননি ফিরহাদ হাকিম।
শতাব্দী প্রাচীন এই শহরে পানীয় জলের সমস্যা দীর্ঘ দিনের। শহরের পরিধি আর লোক বাড়ায়, সঙ্কটের বহর আরও বেড়েছে। ২০০৭ সালে সিউড়িতে জেএনএনইউআরএম (জহরলাল নেহরু ন্যাশনাল আরবান রুরাল মিশন) প্রকল্পে শহরের জন্য জলপ্রকল্পের ঘোষণা করে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। খরচ ধরা হয় ১০ কোটি টাকার কিছু বেশি। খরচের সিংহভাগই (৮০ শতাংশ) কেন্দ্রীয় সরকারের। বাকি ১৫ শতাংশ দিচ্ছে রাজ্য এবং ৫ শতাংশ সংশ্লিষ্ট পুরসভা। ওই সময় কংগ্রেস পুরবোর্ডের আমলে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ২০১০ সালে পুরভোটে বোর্ড দখল করে তাতে হাত লাগায় তৃণমূল। কিন্তু, নির্দল হয়ে জেতা উজ্জ্বলবাবু তৃণমূলে যোগ দিয়ে পুরপ্রধান হওয়ার পর থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে নানা সময়ে বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা নিয়ে দুর্নীতি ও নয়ছয়ের অভিযোগ উঠতে শুরু করে। অভিযোগ তাঁরই দলের কাউন্সিলরদের একাংশ। এ নিয়ে বহু বিক্ষোভ-অনশন করেও কোনও লাভ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত দল ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছেন ওই কাউন্সিলরদের অন্যতম নেতা দীপক দাস।
পুরসভার হিসেব অনুযায়ী, এই শহরে জলের চাহিদা মেটাতে প্রতি দিন ২০ লক্ষ গ্যালন জলের প্রয়োজন। কিন্তু, বর্তমানে চাহিদার থেকে অনেক কম জল দেওয়া হয়। বিরোধীদের অভিযোগ, উদ্বোধনের পরেও শহরের ৩, ৪, ৫ এবং ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে জলের চরম সঙ্কট রয়েছে। ৮ নম্বর ওয়ার্ডের একাংশও এ নিয়ে ভুক্তভোগী। আবার জলের পাইপ লাইনই পৌঁছয়নি ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে! বর্তমানে জলপ্রকল্পের খরচ বাড়তে বাড়তে এখন ১৪.৪৬ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ১২.২৮ কোটি টাকা পুরসভা পেয়েছে। কিন্তু, খরচ বাবদ ইউসি জমা দিয়েছে মাত্র ৭ কোটি টাকার। বাকি ৫.২৮ কোটি টাকা কোথায় গেল, এ নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।
পুরসভার অন্যতম বিরোধী কাউন্সিলর, কংগ্রেসের ইয়াসিন আখতারের মত, তাঁদের দাবি মোতাবেক জলপ্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরকে দেওয়া হলে অনেক দিন আগেই এ কাজ শেষ হয়। এ দিকে, তৎকালীন পুরপ্রধান, বর্তমানে কংগ্রেসের সদস্য তপন শুকুলের দাবি, “আমার আমলে প্রকল্পের জন্য ৪.৪৯ কোটি টাকা পেয়েছিলাম। ওই টাকায় ৯টি বোরিং, চাঁদমারি মাঠে দু’টি ওভারহেড ও পুরসভা চত্বরে দু’টি আন্ডারগ্রাউন্ড জলাধার নির্মাণ, তিন কিলোমিটার রাইসিং পাইপ কেনা ও বসানো এবং ১৭ কিলোমিটার ডিস্ট্রিবিউশন পাইপ কেনা হয়েছিল। আমরা এতটা এগিয়ে রাখার পরেও তৃণমূল পুরবোর্ড আজও জলপ্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারেনি।” পুরপ্রধানের কাজের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে পুরসভা চত্বরে মঞ্চ বেঁধে টানা তিন দিন অনশন করেছিলেন দীপকবাবুরা। এ দিন তিনি বলেন, “স্বপনবাবুর বহু আগে থেকেই আমরা পুরপ্রধানের অনৈতিক কাজের বিরোধিতা করে এসেছি। সেই সময় দলীয় নেতৃত্ব পুরপ্রধানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছিলেন। কিন্তু, বাস্তবে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেওয়া এই পুরবোর্ডের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তৃণমূল কিছুই করেনি। এর পরে ওই দলে থাকা ঠিক বলে মনে করিনি।”
পুরপ্রধান নিজেও অবশ্য মানছেন প্রকল্পের কাজ এখনও বাকি রয়েছে। তবে, তাঁর দাবি, “জোরের সঙ্গে বলছি, জলপ্রকল্পের ৮৫ শতাংশ কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যেই চারটি নতুন জলাধার থেকে জল দেওয়া শুরু হয়েছে। কিছু ডিস্ট্রিবিউশন পাইপ বসানোর কাজ এখনও বাকি আছে। মিউনিসিপাল্টি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টকে (এমইডি) বাকি কাজটা করে দিতে বলেছি।” কিন্তু, প্রকল্পের ৫.২৮ কোটি টাকা কোথায় গেল? পুরপ্রধানের জবাব, “প্রকল্পের ‘ফান্ড ডাইভার্সন’ করে ওই টাকা দিয়ে পুরকর্
এই বিতর্কের মাঝেই দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল সুর চড়িয়েছেন স্বপনবাবুর বিরুদ্ধে। বৃহস্পতিবারই অনুব্রতর প্রতিক্রিয়া ছিল, “স্বপন থাকলেন কি গেলেন তাতে কিছু যায় আসে না। ওঁর জন্য দলের কোনও ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না।” দলের নেতার ওই বক্তব্যের এ দিন স্বপনবাবু বলেন, “অনুব্রতকে দেখে বা ওঁর কথা শুনে তো দলে যোগ দিইনি। তাই ওঁর প্রলাপের কোনও উত্তর দেব না। এটুকু বলতে পারি, দলের অসাধু নেতা-কর্মীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এসেছে। না হলে সামনে সমূহ বিপদ।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy