Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

গোলমাল হতে পারে বোঝেনি কেবল পুলিশই

সবাই আশঙ্কা করেছিল, শুধু পুলিশ ছাড়া! ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। সোমবার মাতৃভূমি লোকাল ঘিরে পূর্ব রেলের বনগাঁ শাখার বিভিন্ন স্টেশনে অবরোধ হয়েছে। এবং হাবরায় একতরফা তাণ্ডব চালিয়েছে এক দল দুষ্কৃতী। ট্রেনের কাচ ভাঙা থেকে শুরু করে মহিলাদের মারধর— কিছুই বাদ যায়নি।

পলায়ন। অবরোধকারীদের ছোড়া ইটের সামনে পুলিশ দিশাহারা। হাবরা স্টেশনে সোমবার। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

পলায়ন। অবরোধকারীদের ছোড়া ইটের সামনে পুলিশ দিশাহারা। হাবরা স্টেশনে সোমবার। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০১৫ ০৩:২৯
Share: Save:

সবাই আশঙ্কা করেছিল, শুধু পুলিশ ছাড়া!

ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। সোমবার মাতৃভূমি লোকাল ঘিরে পূর্ব রেলের বনগাঁ শাখার বিভিন্ন স্টেশনে অবরোধ হয়েছে। এবং হাবরায় একতরফা তাণ্ডব চালিয়েছে এক দল দুষ্কৃতী। ট্রেনের কাচ ভাঙা থেকে শুরু করে মহিলাদের মারধর— কিছুই বাদ যায়নি। বস্তুত, তাণ্ডবের মাত্রার বিচারে গত দু’দিনের ঘটনাকেও ছাপিয়ে গেল এ দিনের বিক্ষোভ।

মাতৃভূমি লোকালের কয়েকটি কামরায় পুরুষ যাত্রীদের প্রবেশের অধিকার দেওয়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রথম শুরু হয়েছিল গত সোমবার। মহিলাদের দেখানো সেই বিক্ষোভের পাল্টা বিক্ষোভ দেখান পুরুষ যাত্রীরা। গত বুধবার প্রতিবাদ মাত্রাছাড়া আকার নেয়। বনগাঁ-শিয়ালদহ শাখার বিভিন্ন স্টেশনে দফায় দফায় চলে অবরোধ। মহিলা কামরায় উঠে মারধরও করা হয় যাত্রীদের। এর পরের দিন, বৃহস্পতিবার রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভুর সঙ্গে বৈঠকে মাতৃভূমিকে শুধু মহিলাদের ট্রেন হিসেবে রেখে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই আবেদন মেনে নিয়ে সুরেশ প্রভু সে দিনই ঘোষণা করেন, মাতৃভূমিতে পুরুষরা উঠতে পারবেন না। আনুষ্ঠানিক ভাবে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে রেল সে কথা ঘোষণা করে শনিবার।


সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

রেলের ঘোষণার পরে সোমবারই ছিল প্রথম কাজের দিন। এবং পুরুষ যাত্রীদের একাংশ যে এ দিন ফের বিক্ষোভ দেখাবে, সেই আশঙ্কা নিত্যযাত্রী মহলে ছিল। জানতেন স্থানীয় বাসিন্দারাও। হাবরার আইএনটিইউসি নেতা চারুদাস মজুমদার বলেন, ‘‘রবিবার থেকেই কানাঘুষো শুনছিলাম, হাবরায় মাতৃভূমি লোকাল আটকে অবরোধ হবে।’’ হাবরার কিছু নিত্যযাত্রীর সঙ্গেও কথা বলে জানা গেল, বৃহস্পতিবার রেলমন্ত্রীর ঘোষণার পরেই পুরুষ নিত্যযাত্রীদের অনেকেই নিজেদের মধ্যে কথা বলে ঠিক করেছিলেন, অবরোধ করা হবে সোমবার। কিন্তু রেল পুলিশ নাকি কিছুই আন্দাজ করতে পারেনি। রেল পুলিশের এডিজি মৃত্যুঞ্জয় কুমার সিংহের কথায়, ‘‘সোমবার যে এত বড় কাণ্ড ঘটবে তা আগে থেকে আঁচ করা যায়নি।’’ আর তাই মাতৃভূমির কামরায় পুরুষ যাত্রীদের উঠতে বাধা দেওয়ার জন্য মাত্র জনা কয়েক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। মারমুখী বিক্ষোভকারীদের সামনে মহিলাদের ফেলে রেখে নিজেদের বাঁচাতে চম্পট দেন তাঁরাও।

গোলমালের আগাম খবর কেন ছিল না তাঁদের কাছে? রেল পুলিশের এক কর্তার ব্যাখ্যা, ‘‘জেলা পুলিশ আমাদের কোনও খবরই দেয়নি।’’ রেল পুলিশ (জিআরপি) এবং জেলা পুলিশ দুটোই রাজ্য পুলিশের বাহিনী। কিন্তু তাদের মধ্যে কেন সমন্বয় থাকবে না সেই প্রশ্ন তুলেছেন যাত্রীরা। হাবরা স্টেশনে দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকা এক নিত্যযাত্রীর প্রশ্ন, ‘‘আমরা ট্রেন থেকেই দেখলাম লাঠিসোঁটা নিয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু মানুষ। স্টেশনে জিআরপি-র ফাঁড়ি রয়েছে। সেখানকার পুলিশ ওই দুষ্কৃতীদের নজর করেনি কেন?’’ আর এক যাত্রীর মন্তব্য, ‘‘মহিলা যাত্রীদের পুরোপুরি অরক্ষিত রেখে যে ভাবে পুলিশ পালিয়ে গেল, তাতে অবাক না হয়ে পারিনি।’’

এ দিন পুলিশ যে কার্যত পালিয়ে গিয়েছে তা স্বীকার করে নিয়েছেন এডিজি রেল-ও। তিনি বলেন, ‘‘উন্মত্ত জনতার তুলনায় পুলিশের সংখ্যা ছিল অনেক কম। ওই অবস্থায় অবরোধ তুলতে লাঠি চালালে হিতে বিপরীত হতে পারত। আরও বড় গণ্ডগোল হতে পারত।’’ কিন্তু যাত্রীদের অভিযোগ, পরে জেলা পুলিশ, কমব্যাট ফোর্স এসেও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি। বরং তখন আরপিএফ এবং উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আরও প্রকট হয়েছে। আরপিএফের বক্তব্য, অবরোধকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁরা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তাঁদের সঙ্গে কথা না বলে আগেই লাঠি উঁচিয়ে রে রে করে জনতার দিকে ধেয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি হিতে বিপরীত হয়েছে। জিআরপি অবশ্য আরপিএফের এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

তবে এ দিনের গোলমাল মিটে যাওয়ার পরে যাত্রীদের সুরক্ষা নিয়ে টনক নড়েছে রেল পুলিশের। এডি়জি রেলের ঘোষণা, ‘আজ, মঙ্গলবার থেকে এই ধরনের অবরোধ, ভাঙচুর বরদাস্ত করা হবে না। পুলিশ কড়া হাতে তা মোকাবিলা করবে। সেই রকম প্রস্তুতিই নেওয়া হয়েছে।’’ তবে তাঁর এই ঘোষণার পরেও মহিলা যাত্রীরা মাতৃভূমিকে উঠতে আর কতটা ভরসা পাবেন, সে প্রশ্ন থেকেই গিয়েছে।

এ দিনের ঘটনার মোকাবিলায় পুলিশি গাফিলতির কথা যেমন উঠছে, তেমনই উঠছে রাজনৈতিক ইন্ধন জোগানোর অভিযোগও। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, পুলিশকে লক্ষ্য করে যারা ইট-পাথর ছুড়েছে, কিংবা ট্রেনে ভাঙচুর চালিয়েছে, তাদের সকলে নিত্যযাত্রীই নয়। স্থানীয় একটি সূত্রেও জানা যাচ্ছে, হাবরা স্টেশনের আশপাশের শ্রীনগর, শ্রীপুর, তেঁতুলতলা, হাটথুবায় থেকে বহু যুবক ঝামেলার সময়ে জুটে গিয়েছিল। এই দাবি যে ঠিক, তার ইঙ্গিত মিলেছে হাবরার এক মহিলা নিত্যযাত্রীর কথায়। তিনি বলেন, ‘‘স্টেশনে এসে দেখলাম, জিআরপি-র কিছু কর্মী আছেন। তেমন ভিড়ও নেই। ভাবলাম আর হয়তো কোনও গোলমাল হবে না। কিন্তু মাতৃভূমি লোকাল ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে যেন পিল পিল করে লোক ঢুকে পড়ল স্টেশনে।’’

আর এখানেই উঠছে রাজনৈতির ইন্ধনের অভিযোগ। খাদ্যমন্ত্রী তথা হাবরার বিধায়ক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, ‘‘সিপিএম-ই এ দিন গোলমালে মদত দিয়েছে। আমরা কিছু লোককে শনাক্তও করেছি।’’ যা শুনে সিপিএমের জেলা নেতা নেপালদেব ভট্টাচার্যের মন্তব্য, ‘‘শাসক দল যেখানেই কোনও ভয় দেখছে, সেখানেই সিপিএম-কে দেখছে। এ দিন যা ঘটেছে, তার সঙ্গে আমাদের দলের কোনও সম্পর্ক নেই।’’ বিরোধীদের অভিযোগ, এই ঘটনার পিছনে রয়েছে শাসক দলেরই একটি গোষ্ঠী। কিন্তু তৃণমূল শিবিরের দাবি, বিক্ষোভ দেখাতে নয়, বিক্ষোভ থামাতেই মাঠে নেমেছিল তারা। বস্তুত, হাবরার পুরপ্রধান তৃণমূল নেতা নীলিমেশ দাসকে লোকজন নিয়ে গিয়ে বিক্ষোভকারী নিত্যযাত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গিয়েছে। ট্রেনে ইট-পাথর ছুড়ছিল যারা, তাদের কাউকে কাউকে ধরে পিটুনি দিতেও দেখা গিয়েছে স্থানীয় কিছু তৃণমূল কর্মী-সমর্থককে।

তবে কোনও পক্ষের উসকানি থাক বা না-থাক, পুলিশের ব্যর্থতা কিন্তু ঢাকা পড়ছে না। যার পিছনে বনগাঁ-শিয়ালদহ শাখার রেল পুলিশের পরিকাঠামোগত সমস্যার কথাও উঠছে। বনগাঁ জিআরপির হাতে কর্মী মেরেকেটে শ’খানেক। যাঁদের মধ্যে বন্দুকধারী পুলিশ কর্মীর সংখ্যা জনা পনেরো। ফলে বড় কোনও গোলমাল সামাল দেওয়ার মতো ক্ষমতা তাদের নেই বললেই চলে। বনগাঁর পরে জিআরপি থানা বারাসতে। কোনও কারণে ট্রেন চলাচল বন্ধ হলে সড়ক পথে সেখান থেকে পুলিশ আসতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এ দিনও তাই হয়েছে। তা ছাড়া, প্রয়োজনে জেলা পুলিশের সঙ্গে কী ভাবে সমন্বয় রেখে কাজ করা যাবে, তারও কোনও ‘গাইড লাইন’ নেই। তার ফল কী হয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল এ দিনের ঘটনা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE