আগুনটা জনমানসে ধিকিধিকি জ্বলছিলই। তাতে ঘি ঢেলেছে ২২ ফেব্রুয়ারি টাউন হলে বেসরকারি হাসপাতালগুলির প্রতিনিধিদের নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠক। সেই আগুনের তাপে এখন পুড়ছে বেসরকারি হাসপাতালগুলি। সিঁটিয়ে থাকা হাসপাতাল-কর্তারা বলছেন, এতটা অসহায় আর অনিশ্চিত পরিস্থিতির মুখোমুখি আগে কখনও পড়েননি। বুঝতে পারছেন না, কী করে পরিস্থিতি সামলাবেন।
হয়তো নিক্তি মাপলে এদের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ কম, কারও বিরুদ্ধে বেশি। কিন্তু বৈঠকের অভিঘাতে জনরোষের সরাসরি আঁচে কমবেশি ঝলসে যাচ্ছে সব বেসরকারি হাসপাতালই।
হাসপাতালগুলির সঙ্গে জড়িতদের একাংশ জানাচ্ছেন, দু’রকম ‘রোষ’ এখন তাঁদের বিরুদ্ধে কাজ করছে। প্রথমটি যথার্থ এবং যৌক্তিক। মাত্রাছাড়া খরচ, ডাক্তার-কর্তৃপক্ষের খারাপ ব্যবহার ও চিকিৎসায় গাফিলতি নিয়ে। যেগুলি দীর্ঘদিন ধরে মানুষ মনে পুষে রেখে গজরাতেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রকাশ্যে উগরে মনের ঝাল মেটাচ্ছেন। পাল্টা প্রশ্ন তুলছেন। এত দিনের জমা বারুদে বিস্ফোরণ হয়েছে।
আর দ্বিতীয় ধরনের ‘রোষ’ হল নকল ও অযৌক্তিক। এই ডামাডোলের বাজারে কিছু সুযোগসন্ধানী রোগী ও তাঁদের বাড়ির লোক হম্বিতম্বি করে হাসপাতাল থেকে নিখরচায় পরিষেবা আদায় করে নিতে চাইছেন। মওকার সুবিধা নিয়ে ‘দাদাগিরি’ দেখিয়ে ফায়দা লুটতে পিছপা হচ্ছেন না। আপাত ভাবে দোষ না থাকলেও আগুনে পরিস্থিতির মুখে সে সব মানতে বাধ্য হচ্ছেন হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ।
বিভিন্ন হাসপাতালের কর্তারা জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রীর গত বুধবারের বৈঠকের পর থেকে দফায়-দফায় এই দু’ধরনের পরিস্থিতিই সামলাতে হচ্ছে তাঁদের। এর জন্য প্রধানত হাসপাতালের ফিল্ড স্টাফ বা গ্রাউন্ড স্টাফদের (যাঁরা প্রধানত রোগীর বাড়ির লোকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখেন) নিয়ে টানা বৈঠক করা হচ্ছে। তাঁদের খুব ধৈর্য ধরে, মাথা ঠান্ডা রেখে, কৌশলে কাজ করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
সল্টলেকের এক বেসরকারি হাসপাতালের কর্তার কথায়, ‘‘কর্মীদের বুঝিয়ে দিয়েছি, মানুষ এখন উত্তেজিত, স্পর্শকাতর হয়ে আছেন। তাঁরা প্রত্যেক ব্যাপারে প্রশ্ন করছেন, কটূক্তি ছুড়ে দিচ্ছেন, সব বিষয়ে হাসপাতালকে সন্দেহ করছেন, হাসপাতাল ঠকাচ্ছে বলে মনে করছেন। ফলে খুব সতর্ক থাকতে হবে।’’ ওই কর্তা বলছেন, ‘‘এমনকী স্থানীয় থানা থেকেও বড়বাবু আমাদের ফোন করে বলেছেন—‘এখন যা অবস্থা তাতে কিন্তু রোগী মারা গেলে আপনারা টাকা না-ও পেতে পারেন। সেই ভাবেই প্রস্তুত থাকুন। কারণ, কেউ টাকা নিয়ে ঝামেলা করলে আমরাও তেমন কিছু করতে পারবো না। পাবলিক সেন্টিমেন্ট এখন বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে।’ ফলে আমাদের অবস্থা বুঝতেই পারছেন। এর পর যদি সরকার আবার চার্জের উপর ক্যাপিং বসায়, আর দেখতে হবে না!’’
এই হাসপাতাল থেকেই গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাজারহাটের এক রোগী ছাড়া পেয়েছেন। হাসপাতাল সূত্রের খবর, তাঁর আগে থেকেই ডায়াবেটিস ছিল। তিনি তা লুকিয়েছিলেন বলে বিমা সংস্থা তাঁকে মেডিক্লেমের টাকা দেয়নি। ২৪ তারিখ রোগীর বাড়ির লোক হঠাৎ হাসপাতালের উপর ক্ষেপে ওঠেন। অভিযোগ তোলেন, বিমা সংস্থার সঙ্গে হাসপাতালের যোগ রয়েছে এবং এ ব্যাপারে তাঁরা নবান্ন পর্যন্ত যাবেন। এমনিতেই চাপ। তার উপরে এই নয়া আতঙ্ক। আর বিপদ বাড়াতে না-চেয়ে নিজেদের কোনও দোষ না-থাকা সত্ত্বেও বিলের ৫০ হাজারের মধ্যে মাত্র ২০ হাজার টাকা পেয়ে রোগীকে ছেড়ে দিয়েছে ওই হাসপাতাল।
মুকুন্দপুরের এক হাসপাতালে ৬২ হাজার টাকার প্যাকেজে জরায়ুর টিউমার অপারেশন করিয়েছিলেন হাওড়ার আন্দুলের এক মহিলা। বুধবার মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকের ঠিক পরের দিন, বৃহস্পতিবার ওই মহিলার ছুটির সময় প্যাকেজের পুরো টাকা দিতে বেঁকে বসেন তাঁর বাড়ির লোক। অযথা সামান্য অস্ত্রোপচারের জন্য অতিরিক্ত প্যাকেজ নেওয়া হয়েছে বলে চিৎকার শুরু করেন। একেই পরিস্থিতি খারাপ। তাই ঝুঁকি না নিয়ে ৩৫ হাজার টাকা নিয়েই রোগীকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন কর্তৃপক্ষ। এটা যদি ‘অযৌক্তিক’ রোষের কাহিনি, ‘যৌক্তিক’ রোষের গল্পও তবে রয়েছে।
যেমন, বাইপাসের ধারে বেলঘাটা কানেক্টরের কাছে এক নামী হাসপাতালে হুইল চেয়ারের জন্যও টাকা নেওয়া হয়। পাশাপাশি, হৃদরোগের সমস্যা নিয়ে এলেই গড়পড়তা সবাইকে ৩০ হাজার টাকার একটা নির্দিষ্ট সিটি স্ক্যান করতে বলা, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজির রোগীদের প্রায় প্রত্যেককে ৪২ হাজার টাকার একটা স্ক্যান করতে বাধ্য করা, হাসপাতাল থেকেই ওষুধ ও রক্ত কিনতে বাধ্য করা, সিঙ্গল কেবিনে থাকলে শারীরিক পরীক্ষা খাতে বেশি টাকা নেওয়া, নামী কয়েক জন ডাক্তারের দুর্ব্যবহারের মতো অনেক অভিযোগ অনেক দিন ধরেই ছিল। হাসপাতাল সূত্রের খবর, এত দিন বিরক্ত, ক্ষুব্ধ হলেও রোগীরা সরাসরি সেটা জানাতে সাহস পেতেন না। পাছে তাতে রোগীর অবহেলা হয়। কিন্তু ২২ তারিখের পর থেকে তাঁরা মুখ খুলেছেন।
ওই হাসপাতালেই গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজির এক তথাকথিত নামী চিকিৎসককে এক রোগীর মেয়ে (যিনি নিজে একজন অধ্যাপিকা) মুখের উপর আঙুল তুলে বলেছেন, ‘‘যখনই বাবা-র ঠিক কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করি, আপনি এমন ভাব করেন যেন আমরা পোকামাকড়! জবাব দেন না, হঠিয়ে দেন। অথচ, টাকা নেওয়ার ব্যাপারে কোনও কমতি নেই। মুখ্যমন্ত্রী ঠিক বলেছেন। সব রূপ জানা হয়ে গিয়েছে আপনাদের! এ বার যদি উত্তর না-পাই, তা হলে অন্য ব্যবস্থায় যাব!’’ হতভম্ব চিকিৎসককে কোনও মতে রোষের মুখ থেকে সরিয়ে নিয়ে যান তাঁর জুনিয়রেরা।
মুকুন্দপুরের এক হাসপাতালের এক চিকিৎসক আবার বললেন, ‘‘আমাদের হাসপাতাল সরকারি হেল্থ স্কিমে আছে। কিন্তু আমাদের মতো অনেকেই হেলথ স্কিমের রোগী দেখতাম না। সেটা বাধ্যতামূলকও নয়। অথচ গত কাল হাসপাতালে এক রোগী আমার টেবিল চাপড়ে হুমকি দিয়ে গিয়েছে, আমি তাঁকে হেলথ স্কিমে না-দেখলে আমার বিরুদ্ধে নবান্নে অভিযোগ জানাবেন!’’
ইকবালপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালের কর্তাদের গত কয়েক দিনের অভিজ্ঞতায়, ‘‘২২ তারিখের পর থেকে প্রকাশ্যে বহু রোগী বা তাঁদের বাড়ির লোক আমাদের চোর, ডাকাত, কমিশনখোর — যা ইচ্ছে তাই বলছেন! এক দল এসে বললেন, ‘‘কই, অনেক তো রক্ত চুষেছেন! এ বার একটু আপনাদের মানবিক মুখ দেখান। ডিসকাউন্ট দিন!’ বলে আটচল্লিশ হাজার টাকা বিলে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে দলবল নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন! আরেক জন দু’বছরের পুরনো স্টেন্টের বিল এনে হাজির। তাঁর দাবি, এই ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে স্টেন্টের দাম কমে গিয়েছে। তাই তাঁকে ওই দাম অনুযায়ী বাকি টাকা ফেরত দিতে হবে!’’
একটা ব্যাপারে হাসপাতালের কর্তাদের অনেকেই একমত, এক শ্রেণির হাসপাতালের অতিশোষণ, লোকঠকানো, লাগামছাড়া লাভ করতে চাওয়ার ফল ভুগতে হচ্ছে সকলকেই। এবং এই অবস্থা থেকে আশু মুক্তির কোনও সম্ভাবনা নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy