জামাত জঙ্গিদের সাহায্য নিয়ে আগামী বছরের গোড়ার দিকে তালিবান জঙ্গিরা পশ্চিমবঙ্গে বড় ধরনের নাশকতা ঘটাতে পারে বলে জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। তাঁদের আশঙ্কা, কলকাতা শহরের কোনও বড় বাড়ি, এমনকী মার্কিন কনস্যুলেটও জঙ্গিদের আক্রমণের লক্ষ্য হতে পারে। আগামী কাল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকের সময়ই এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তাঁকে জানাতে চলেছে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল।
আগামী কাল সকালে কলকাতায় পৌঁছবেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। তাঁর সঙ্গে থাকবেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা প্রধান আসিফ ইব্রাহিম, ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড (এনএসজি)-এর ডিজি জয়ন্ত নারায়ণ চৌধুরী ও কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র ডিজি শরদ কুমার। ডোভাল ও তাঁর সঙ্গীরা বিমানবন্দর থেকে সোজা যাবেন বর্ধমানে। সেখান থেকে কলকাতায় ফিরে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করবেন তিনি।
রাজ্যে জঙ্গি কার্যকলাপ নিয়ে নবান্নে ডোভালের সঙ্গে আগামী কালের এই বৈঠকের আগেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বিষয়গুলি নিয়ে অন্তত তিন বার কথা বলেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। এ বারের বৈঠকের আগে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে যথেষ্ট ‘হোমওয়ার্ক’ করা হয়েছে। রাজ্যের বর্তমান মুখ্যসচিব (যিনি একদা যুগ্ম-সচিব হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন) সঞ্জয় মিত্রও বিষয়গুলি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি নৃপেন মিশ্রর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছেন। ডোভালের আসার প্রস্তাব রাজ্য সরকারের কাছে পেশ করা হলে এক কথায় রাজি হয়ে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁদের নবান্নে আসার সাদর আমন্ত্রণও জানান তিনি। সূত্রের খবর, কেন্দ্র ও রাজ্যের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং বাংলাদেশ থেকে পাওয়া তথ্য একত্রিত করে একটি রিপোর্ট তৈরি করেছে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার অফিস। আগামী কাল সেই রিপোর্টের তথ্য মমতাকে জানানো হবে।
মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, কেন্দ্র যেমন রাজ্যকে তালিবান সংক্রান্ত সবিস্তার তথ্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তেমনই মমতাও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে কেন্দ্রকে এ বিষয়ে সব রকম ভাবে সাহায্যের আশ্বাস দেবেন তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “সন্ত্রাসের সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। সন্ত্রাস নিয়ে রাজনীতি কাঙ্খিত নয়। সন্ত্রাস মোকাবিলার জন্য সকলকে একজোট হতে হবে।”
প্রশ্ন উঠেছে, বর্ধমান বিস্ফোরণের পর যখন এনআইএ নাশকতার বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চালাচ্ছে, তখন হঠাৎ অজিত ডোভাল মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতে চাইলেন কেন? বিজেপির রাজ্য নেতাদের মধ্যেও কেউ কেউ এ নিয়ে কেন্দ্রের কাছে প্রশ্ন তুলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্রে বলা হচ্ছে, এই সফরের সঙ্গে বিজেপি বনাম তৃণমূল রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। বর্ধমানের ঘটনা কেন্দ্র ও রাজ্য দু’পক্ষেরই বহু বিষয়ে চোখ খুলে দিয়েছে। জঙ্গিদের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যেই বহু তথ্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছে। এর আগে দিল্লিতে কর্মরত বাংলাদেশের বিদায়ী হাইকমিশনার তারিক করিম পশ্চিমবঙ্গে জঙ্গিদের সক্রিয় হয়ে ওঠা নিয়ে সতর্ক করেছিলেন মনমোহন সিংহের সরকারকেও। কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সূত্রের বক্তব্য, শেখ হাসিনার সরকার যে ভাবে ভারত সরকারকে সহযোগিতা করছে, তাতে নরেন্দ্র মোদীর সরকার কৃতজ্ঞ।
রবিবার রাতে বর্ধমানে অরবিন্দ স্টেডিয়ামে পৌঁছল
সিআরপি-র ৩৬ জনের একটি দল। আপাতত তারা
এখানে থাকবে বলে খবর। ছবি: উদিত সিংহ।
প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্র বলছে, পশ্চিমবঙ্গ যে ভাবে একটা ঘুমন্ত বারুদের স্তূপ হয়ে রয়েছে, সেটা মুখ্যমন্ত্রীকে সবিস্তার জানানোটা বিশেষ জরুরি। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, বাংলাদেশের জামাতুল মুজাহিদিন (জেএমবি) গোষ্ঠীটি যথেষ্টই সক্রিয়। এই গোষ্ঠীর স্লোগান ‘আমরা হব তালিবান, বাংলাদেশ হবে আফগানিস্তান।’ চট্টগ্রামের গ্রেনেড হামলা, বাংলাদেশের ব্রিটিশ হাইকমিশনের উপর আক্রমণ এবং শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিডিআর-বিদ্রোহ এর সবগুলির পিছনেই জেএমবি-সহ একাধিক মৌলবাদী গোষ্ঠী যুক্ত ছিল। অজিত ডোভালদের রিপোর্ট অনুসারে, আল কায়দার শাখা সংগঠন হিসেবেই এই সব গোষ্ঠী বিকশিত হয়েছে। যখনই সরকার এগুলিকে নিষিদ্ধ করেছে, তখনই এরা নতুন নাম নিয়ে ফের নেমে পড়েছে।
ডোভালের সঙ্গে বৈঠকের আগে রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে একটি গোয়েন্দা রিপোর্ট তৈরি করে রেখেছেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের বক্তব্য, দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গ জঙ্গিদের নিশানায় রয়েছে। এবং এর অন্যতম কারণ হল, পশ্চিমবঙ্গের চার পাশে বাংলাদেশ, নেপাল-সহ একাধিক রাষ্ট্রের উপস্থিতি। এদের মাধ্যমে পরোক্ষে চিন ও মায়ানমারের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতে পারে জঙ্গিরা। এই কারণেই কেন্দ্রও বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝেই তারা খাগড়াগড় নিয়ে এতটা সক্রিয় হয়েছে। খাগড়াগড়-তদন্তের গোড়ার দিকে রাজ্য ভরসা রেখেছিল সিআইডি-র উপরে। কেন্দ্রীয় তদন্তে তাদের আপত্তিও ছিল। কিন্তু জঙ্গিদের বাড়বাড়ন্তে উদ্বিগ্ন কেন্দ্র তদন্তের ভার তুলে দেয় এনআইএ-র হাতে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের কথায়, “এনআইএ-কে দিয়ে যে তদন্ত করা হয়েছে, তা রাজ্য সরকারকে জানিয়েই করা হয়েছে। রাজ্য আমাদের যে চিঠি দিয়েছে, তাতে এই তদন্তের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনও আপত্তি জানায়নি তারা। আইন-শৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয়। কিন্তু সন্ত্রাস জাতীয় বিষয়। সেই কারণে এই সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত করা হচ্ছে। প্রয়োজনে তারা দোষীদের সরাসরি গ্রেফতারও করতে পারে। ইতিমধ্যেই কয়েক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রয়োজনে আরও হবে।” মমতা অবশ্য আগামিকাল ডোভালকে বলবেন, আইন-শৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয়। কাজেই রাজ্যের সঙ্গে সংঘাতের পথে গিয়ে সমস্যার সমাধান হতে পারে না। বরং কেন্দ্র ও রাজ্য যৌথ সহযোগিতার মাধ্যমেই সন্ত্রাস মোকাবিলা সম্ভব।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনহা প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেছেন, শাসক তৃণমূল এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি এবং দুর্নীতির জন্য জামাতের মতো গোষ্ঠীকে মদত দিচ্ছে। এই বিষয়ে রাজ্যসভার সদস্য আহমেদ হাসান ইমরানের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে তারা। যার পাল্টা হিসেবে বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন ইমরান। এ প্রসঙ্গে সিদ্ধার্থনাথ বলেন, “আমাদের অনুমান, আগামিকাল সুকৌশলে কেন্দ্র মমতাকে জানিয়ে দেবে যে, ইমরান ও তাঁর কার্যকলাপ সম্পর্কে কেন্দ্র অবহিত। যে হেতু ইমরান রাজ্যসভার দলীয় সদস্য, তাই তাঁর বিষয়ে প্রকৃত তথ্য মুখ্যমন্ত্রীকে জানানোটা কেন্দ্রের কর্তব্য।”
১৯৯৩ সালে মুম্বইয়ে ধারাবাহিক বিস্ফোরণের কারিগর ছিল মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিম। সেই বিস্ফোরণের পর পশ্চিম উপকূলবর্তী এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর করা হয়। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের নজরদারিও বাড়ে। তার পর থেকেই তালিবান ও পাক জঙ্গিরা কৌশল বদলে পূর্ব উপকূলবর্তী এলাকাকে নিশানা করে। তখন থেকেই কেন্দ্র বারবার রাজ্যকে সতর্ক করেছে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলে মার্কিন তথ্যকেন্দ্রে হামলা হয়েছে। মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর রাজ্যে এসে হিলারি ক্লিন্টন জানান, জঙ্গিরা কী ভাবে বাংলাদেশের জমিকে ব্যবহার করে পশ্চিমবঙ্গকে নিশানা করছে। শেখ হাসিনার সরকার জঙ্গি দমনে কতটা ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছে, তা-ও কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে জানিয়েছিলেন হিলারি। প্রশ্ন উঠেছে, এত সতর্কবার্তা সত্ত্বেও এত বছরে পশ্চিমবঙ্গ কেন ব্যবস্থা নেয়নি? রাজ্যের পাল্টা অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। যার অনেকটাই অরক্ষিত। সীমান্ত দেখার দায়িত্ব বিএসএফের। তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই জঙ্গিরা চোরাপথে এ রাজ্যে ঢুকছে। আগামিকালের বৈঠকে এ সব প্রশ্ন নিয়ে বোঝাপড়ার চেষ্টা হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy