Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

কলার ধরে শাসানি, বহিষ্কৃত যুব তৃণমূল নেতা

ফের সরকারি অফিসে ঢুকে আধিকারিকদের মারধর, কটূক্তি করায় অভিযুক্ত শাসকদলের নেতা। তবে এ বার দল কঠোর অবস্থান নিল গোড়াতেই। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পরে রাতেই অভিযুক্তকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত জানান তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। শুক্রবার মালদহের ইংরেজবাজারে বিদ্যুৎ দফতরে তৃণমূল যুব কংগ্রেসের জেলা সহ-সভাপতি বিশ্বজিৎ রায় ওরফে ‘বুলেট’ ও তাঁর অনুগামীরা দুই অফিসারকে হেনস্থা করেন। রীতিমতো ধমক দিয়ে, কলার ধরে চড় মারার হুমকি দেন বিশ্বজিৎ।

বিদ্যুৎ সংস্থার সহকারী ম্যানেজার অনির্বাণ সাহাকে মারতে উদ্যত যুব তৃণমূলের জেলা সহ-সভাপতি বিশ্বজিৎ রায়। ছবি: মনোজ মুখোপাধ্যায়।

বিদ্যুৎ সংস্থার সহকারী ম্যানেজার অনির্বাণ সাহাকে মারতে উদ্যত যুব তৃণমূলের জেলা সহ-সভাপতি বিশ্বজিৎ রায়। ছবি: মনোজ মুখোপাধ্যায়।

নিজস্ব প্রতিবেদন
মালদহ শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:৫২
Share: Save:

ফের সরকারি অফিসে ঢুকে আধিকারিকদের মারধর, কটূক্তি করায় অভিযুক্ত শাসকদলের নেতা। তবে এ বার দল কঠোর অবস্থান নিল গোড়াতেই। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পরে রাতেই অভিযুক্তকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত জানান তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব।

শুক্রবার মালদহের ইংরেজবাজারে বিদ্যুৎ দফতরে তৃণমূল যুব কংগ্রেসের জেলা সহ-সভাপতি বিশ্বজিৎ রায় ওরফে ‘বুলেট’ ও তাঁর অনুগামীরা দুই অফিসারকে হেনস্থা করেন। রীতিমতো ধমক দিয়ে, কলার ধরে চড় মারার হুমকি দেন বিশ্বজিৎ। চড় মারার জন্য হাতও তোলেন। প্রায় এক ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রেখে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার দুই আধিকারিককে ক্রমাগত গালিগালাজ, ধমকধামক চালিয়ে যায় যুব তৃণমূলের ওই সদস্যরা। পুলিশ দেরিতে আসে, তার পরেও কার্যত দর্শকের ভূমিকা নেয় বলে অভিযোগ।

প্রসঙ্গত, এর আগে বীরভূমের তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সহ-সভাপতি সুদীপ্ত ঘোষের বিরুদ্ধে বোলপুর থানায় ঢুকে পুলিশ পেটানোর অভিযোগ উঠেছিল। বেশ কিছু দিন নিখোঁজ থাকার পর তিনি আগাম জামিন নেন। তবে মালদহের ঘটনার পর রাতে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানান, বিশ্বজিৎকে ছ’বছরের জন্য দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। পুলিশকেও ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। পার্থবাবু বলেন, “এই কার্যকলাপ দল কখনই সহ্য করবে না।”

বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্ত ফোন ধরেননি, মেসেজেরও উত্তর দেননি। তবে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার চেয়ারম্যান নারায়ণস্বরূপ নিগম বলেন, “ওই অঞ্চলে ‘স্পট বিলিং’ নিয়ে কিছু সমস্যা হয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”

কেন বিদ্যুৎ কর্মীদের উপরে এই হামলা? জানা গিয়েছে, বিদ্যুতের অত্যধিক বিল-সহ নানা বিষয়ে ডেপুটেশন দিতে দুপুর ১২টা নাগাদ বিশ্বজিৎবাবুর নেতৃত্বে যুব তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা বিদ্যুৎ দফতরের বিভাগীয় ম্যানেজারের ঘরে ঢুকে পড়ে। সেই সময়ে বিভাগীয় ম্যানেজার শৈবাল মজুমদার না থাকায় আরও খেপে ওঠে তারা। ঘরে ছিলেন দুই সহকারী ম্যানেজার অনির্বাণ সাহা ও আলারি বিজয়শঙ্কর। অভিযোগ, আধিকারিকদের চেয়ার থেকে ধাক্কা দিয়ে তুলে দেয় বুলেট। তাঁরা যাতে বসতে না পারেন, তার জন্য চেয়ার সরিয়ে দেওয়া হয়। অনির্বাণবাবুর জামার কলার ধরে অকথ্য গালি দিয়ে বুলেট চড় মারতে হাত তোলে। দফতরের আর এক কর্মীকে দিয়ে পাশের ঘর থেকে অন্য কর্মীদের ডাকিয়ে এনেও হেনস্থা করা হয়। দফতরের কর্মীরাই জানান, প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ঘরে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে তাঁদের ক্রমাগত কটূক্তি করে যুব তৃণমূল কর্মী-সমর্থকরা।

বিক্ষোভ শুরু হওয়ার সময়েই দফতরের কর্মীরা ইংরেজবাজার থানায় ফোনে খবর দেন। মোটে শ’পাঁচেক মিটার দূরে হলেও সেখান থেকে প্রায় ৪৫ মিনিট পরে পুলিশ আসে বলে অভিযোগ। তার পরেও বেশ কিছু ক্ষণ গালিগালাজ চলে। শেষ পর্যন্ত পুলিশের কয়েক জন অনুনয়-বিনয় করে নেতাদের বাইরে নিয়ে যান। তবে যাওয়ার সময়ে বুলেট হুমকি দিয়ে যায়, বিভাগীয় ম্যানেজারকে পরে আবার এমন করেই হেনস্থা করা হবে। ঘটনাস্থল থেকে কাউকে আটক করেনি পুলিশ। রাত অবধি কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়নি।

তবে এই ঘটনার পরেও বিদ্যুৎ পর্ষদের তরফে জানানো হয়েছে, পুলিশের কাছে কোনও অভিযোগ করা হবে না। নিগৃহীত কর্মী অনির্বাণ সাহা বলেন, “মুখ খোলার অনুমতি নেই। যা হয়েছে সকলের সামনেই। এর বেশি কিছু বলব না।” মালদহ বিভাগের বিভাগীয় ম্যানেজার শৈবাল মজুমদারের দাবি, তিনি যা শুনেছেন তাতে অভিযোগের তেমন কিছু নেই। মালদহের পুলিশ কর্তারাও বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছেন। মালদহের এসপি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় ফোন ধরেননি। এএসপিকে ফোন করা হলে তিনি এসএমএসে জানান, ছুটিতে আছেন। ইংরেজবাজারের আইসি দিলীপকুমার কর্মকার অবশ্য বলেন, “অভিযোগ পেলে পুলিশ খতিয়ে দেখবে।”

কে এই বুলেট?

স্থানীয় সূত্রের খবর, মালদহ কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতক ওই বছর তিরিশেকের যুবক। ছাত্র অবস্থায় রাজনীতি না করলেও, ২০০৯ সাল থেকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তৎকালীন যুব তৃণমূলের জেলা সভাপতি আব্দুল খালেকের স্নেহধন্য হয়ে ওঠার পরে তাকে যুব তৃণমূলের টাউন সভাপতি করা হয়। এর পরে তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি দুলাল সরকারের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে সে। ইদানীং তৃণমূলের জেলা সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেনের ঘনিষ্ঠ বলে সে দলে পরিচিত।

সরকারি দফতরে যুব তৃণমূলের তাণ্ডবের দৃশ্য টিভিতে প্রচারিত হওয়ার পরেই অবশ্য জেলার নেতারা বুলেট ও তার সঙ্গীদের থেকে দূরত্ব বাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ইংরেজবাজারের বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী বলেন, “যুব তৃণমূলের ব্যাপার। আমার থেকে যুব তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ভাল বলতে পারবেন।” তৃণমূল নেত্রী তথা মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র দলের জেলা সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেনের কোর্টে বল ঠেলেছেন। আর তৃণমূলের জেলা সভাপতির দাবি, “আমার জানা নেই।’’ তৃণমূল যুব কংগ্রেসের জেলা সভাপতি অম্লান ভাদুড়ির দাবি, এ দিন যুব তৃণমূলের কর্মসূচিই ছিল না।

অভিযুক্ত বিশ্বজিৎ ওরফে বুলেটের দাবি, ‘কিছুই হয়নি।’ তার পাল্টা অভিযোগ, “রাজ্যে পরিবর্তন হলেও এখানকার বিদ্যুৎ দফতরের ম্যানেজারকে কংগ্রেস আর সিপিএম চালাচ্ছে। সাবমার্সিবল পাম্পের জন্য চাষিরা সরাসরি আবেদন করেও পাচ্ছে না। দালালরাজ চলছে। মুখ্যমন্ত্রীকে বদনাম করা হচ্ছে। তাই বিক্ষোভ দেখিয়েছি।” তার দাবি, আধিকারিকদের মারের অভিযোগ ঠিক নয়।

বিশ্বজিৎ রাজনৈতিক চক্রান্ত দেখলেও, বিদ্যুৎ কর্মীদের একাংশ এই বিক্ষোভের পিছনে ব্যক্তিগত স্বার্থ খুঁজে পাচ্ছেন। দক্ষিণ মালদহ ডিভিশনে গোড়ায় যে বেসরকারি সংস্থাটি ‘স্পট বিলিং’-এর বরাত পেয়েছিল, তাদের কাজে বণ্টন কর্তৃপক্ষ অসন্তুষ্ট। সম্প্রতি তাদের বেশ কয়েকটি গ্রাহক পরিষেবা কেন্দ্র থেকে সরিয়ে অন্য একটি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। অভিযোগ, বাতিল সংস্থাটির কর্মীদের অনেকে এ দিনের বিক্ষোভে উপস্থিত ছিল।

বিদ্যুৎ চুরি রুখতে গিয়ে কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক হয়রানির মুখে পড়লেন কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে। কলকাতার এক বিদ্যুৎকর্তা জানান, আগে এক শ্রেণির অসাধু বিদ্যুৎকর্মী কিছু গ্রাহকের সঙ্গে আর্থিক সমঝোতা করে কম বিল করত। এখন ‘স্পট বিলিং’ চালু হওয়ায় ঠিক বিল দিতে হচ্ছে। তার অঙ্কও আগের তুলনায় বেশি হচ্ছে। এই অসৎ গ্রাহকদের পক্ষ নিয়েই শাসকদলের নেতারা সরকারি কর্মীদের হেনস্থা করছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে।

অন্য বিষয়গুলি:

bulet tmc biswajit roy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE