Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

ফিরে আসুক আত্রেয়ী, চাইছে শহরবাসী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমাদের ছোট নদীর মতো বালুরঘাটের আত্রেয়ীতেও বৈশাখ জৈষ্ঠ্যের কিছু সময় বরাবর হাঁটু জল থাকে। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে জেগে ওঠা নদীর চড়ে তরমুজ, খিরা এবং বাঙি চাষ করতে কোম়র বেঁধে নেমে পড়েন চাষিরা। এ বারেও তার অন্যথা হয়নি।

এই বাঁধ দেওয়ার জন্যই নদী শুকিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ। ছবি: অমিত মোহান্ত।

এই বাঁধ দেওয়ার জন্যই নদী শুকিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ। ছবি: অমিত মোহান্ত।

অনুপরতন মোহান্ত
বালুরঘাট শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৫ ০৪:১৬
Share: Save:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমাদের ছোট নদীর মতো বালুরঘাটের আত্রেয়ীতেও বৈশাখ জৈষ্ঠ্যের কিছু সময় বরাবর হাঁটু জল থাকে। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে জেগে ওঠা নদীর চড়ে তরমুজ, খিরা এবং বাঙি চাষ করতে কোম়র বেঁধে নেমে পড়েন চাষিরা। এ বারেও তার অন্যথা হয়নি।

গত মাসের শুরুতে ঘটনাটি ঘটল। গরমে প্রায় শুকিয়ে যাওয়া আত্রেয়ী ও তার বিস্তীর্ণ বালির চড়ে বোনা তরমুজ ও খিরা এক রাতের মধ্যে ভেসে গেল। হড়পা বানের মতো নদী তখন ফুলে উঠেছে। মাহিনগর ও পরাণপুর এলাকার তরমুজ চাষিদের মাথায় হাত। এক রাতের মধ্যে কী এমন হল যে শীর্ণ আত্রেয়ী জলে ভরে গিয়ে স্রোতের টানে ফসল ভাসিয়ে নিয়ে গেল?

চাষিরাই কারণ অনুসন্ধান করে অভিযোগ করেন, এ জেলার কুমারগঞ্জ ব্লকের সমজিয়া থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার ওপারে বাংলাদেশের দিকে আত্রেয়ী বরাবর আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে জল আটকে, কখনও জল ছেড়ে দিয়ে পুরো নদীকে নিয়ন্ত্রণ করায় ওই দুর্ভোগ। নদীর মুখে তৈরি ওই বাঁধ থেকে হঠাৎ জল ছেড়ে দেওয়ায় চাষিদের সব ফসল ভেসে তছনছ হয়ে যায়। দু’দিন পরে জল শুকিয়ে আত্রেয়ী ফের আগের শীর্ণ চেহারায়।

শহরের পরিবেশ সংগঠনগুলি খবর পেয়ে তথ্য অনুসন্ধানে নেমে পড়ে। ইন্টারনেটে উপগ্রহ চিত্র থেকে আবিষ্কৃত হয় দক্ষিণ দিনাজপুরের কুমারগঞ্জের সমজিয়া অঞ্চলের ওপারে বাংলাদেশের মোহনপুরে চিরিবন্দর এলাকায় বিশাল রাবার-ড্যাম তৈরি করে চলতি বছর থেকে আত্রেয়ীকে নিয়ন্ত্রণ শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। ওই ড্যাম উপচে সামান্য জল এপারে গড়িয়ে আসতে-আসতে কুমারগঞ্জেই তার গতিপথ থমকে যাচ্ছে। বালুরঘাটের দিকে জলহীন আত্রেয়ীর শুকনো ধুধু বালির চর।

শহরের এক দল যুবক আত্রেয়ী সত্যাগ্রহ মুভমেন্ট কমিটি তৈরি করে আন্দোলন শুরু করেন। পরিবেশপ্রেমী সংস্থাগুলিও প্রতিবাদ আন্দোলনে নামে। আত্রেয়ী রক্ষায় গান বেধে, নাটক তৈরি করে পথে নামেন ছাত্রছাত্রীরা। পথসভা থেকে মোমবাতি মিছিলে হাঁটেন নাট্যকর্মীরা। কাগজের নৌকো ভাসিয়ে নদীর চরে মানববন্ধন তৈরি করে হোমযজ্ঞের মাধ্যমে আন্দোলনের পাশাপাশি সোস্যাল মিডিয়াতে আত্রেয়ীকে বাঁচাতে ঝড় তোলেন তরুণ প্রজন্মের যুবক যুবতীরা। বাংলাদেশের থেকেও প্রতিক্রিয়া আসতে থাকে। নদীর জন্য বালুরঘাটে অরাজনৈতিক ভাবে এক দল তরুণতুর্কির আন্দোলনের খবর পেয়ে নদী বিশেষজ্ঞ সুপ্রতিম কর্মকার বলেন, আত্রেয়ীর জন্য বালুরঘাটের ওই আন্দোলন পথ দেখাবে। সমস্ত নদী রক্ষায় সবাইকে সরব হতে হবে।

আত্রেয়ীর দুর্দশায় কেবল মৎস্যজীবী ও কৃষককূল সংকটে পড়েননি। চরম সংকটে পড়েছে সেচ দফতর। আত্রেয়ীর উপর নির্ভরশীল এ জেলার ২৫১টি রিভারলিফ্ট ইরিগেশন কেন্দ্র (আরএলআই) জলের অভাবে অকেজো হয়ে পড়েছে। রাজ্যের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় এ জেলার বাম বিধায়ক নর্মদা রায়ের আত্রেয়ীর জল সংকট বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরে বলেন, বিধানসভায় বাংলাদেশের দিকে বাঁধ দেওয়ায় সমস্যা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী আত্রেয়ীর সমস্যা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন।

জলহীন আত্রেয়ীর জন্য শহরের প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য আমূল বদলে গিয়েছে। জেলাশাসক তাপস চৌধুরীর কথায়, ‘‘দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বালুরঘাটে রয়েছি। কিন্তু এ বারে গরম যেন কিছুতেই কমতে চাইছে না। অন্যান্য বছর সন্ধ্যা থেকে ধীরে ধীরে তাপ কমে যেত। এবছর রাত পর্যন্ত গরমের ভাপ রয়ে গিয়েছে। ভোর থেকে তাপমাত্রা কমার মুখেই আবার প্রখর তেজ নিয়ে সূর্য উঠে চড়া রোদে সব পুড়িয়ে দিচ্ছে।’’ শহর ঘেঁষে বয়ে চলা বিশালকায় আত্রেয়ী নদী বায়ুমন্ডল ঠান্ডা করবে কী করে, জল কই? নদীগর্ভে তেতে ওঠা শুকনো বালিতে দাবদাহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

এক বিধ্বংসী ধসে কবেই তিস্তার সঙ্গে আত্রেয়ী বিছিন্ন হয়ে গিয়েছে। কিন্তু অতীত সম্পর্ক ফের তিস্তা জলবণ্টন ইস্যুতে ফিরে আসবে ভাবেননি বালুরঘাটের আন্দোলনরত পরিবেশ বান্ধবেরা। আত্রেয়ী নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে মুখ্যমন্ত্রীর চিঠি এবং সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরে থেকে জলবণ্টন নিয়ে দুদেশের আলোচনা জারির মধ্যে আত্রেয়ীও জায়গা করে নেবে বলেই আশা জাগছে বালুরঘাটের। কাল, ১৬ জুন দিনাজপুরের মাটিতে পা দেবেন মুখ্যমন্ত্রী। এই সফরে তাঁর দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটে আসবার কথা শোনা যেতে শহরের পরিবেশ সংস্থাগুলি মুখিয়ে ছিল। আত্রেয়ীর সমস্যা নিয়ে সরাসরি তাঁর হাতে নথিপত্র দিয়ে কথা বলার সুযোগ হবে বলে আশা করেছিলেন তারা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ যাত্রায় বালুরঘাটে আসছেন না ঠিক, তবে চিঠিচাপাটি, দাবি সনদ পাঠানোর পাশাপাশি আত্রেয়ী রক্ষায় আন্দোলন জারি থাকবে বলে পরিবেশ বান্ধব তুহিন, সুমিত, নিরূপম, অভিজিৎ, জয়, কমলিকা, রুহানি, শ্রেষ্ঠাদের অবিচল মনোভাবে ভরসা বাড়ছে শহরের।

অন্য বিষয়গুলি:

Balurghat Atrai River water Mahinnagar farmer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy