গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
ঘটনা ১: বনগাঁর যুবকটির লটারি কাটার নেশা ছিল না। কৌতূহলবশত একটি টিকিট কেটেছিলেন। ৩০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে মিলেছিল ২২৫০ টাকা টাকা। তাতেই উৎসাহ বেড়ে যায়। এরপর থেকে আরও টাকা জেতার আশায় টিকিট কাটতে শুরু করেন। এক সময়ে বিষয়টি কার্যত নেশায় পরিণত হয়। তিন মাসে কয়েক লক্ষ টাকার টিকিট কেটে ফেলেন! পুরস্কার মিলেছে সামান্যই। বাড়িতে জমানো টাকা যা ছিল, প্রায় সব শেষ। কিন্তু লটারি কাটা বন্ধ হয়নি। যুবকের কথায়, “লটারির টিকিটে অনেক টাকা চলে গিয়েছে। আমার লাভের টাকার দরকার নেই। যে টাকা চলে গিয়েছে, সেই টাকা তুলতে পারলেই টিকিট কাটা ছেড়ে দেব। বড় অঙ্কের টাকা পুরস্কার জেতার অপেক্ষায় রয়েছি।” এবং এই আশায় দিনের পর দিন খোয়াচ্ছেন আরও টাকা!
ঘটনা ২: গাইঘাটার বাসিন্দা এক যুবকের প্যান্টের পকেট থেকে গোছা গোছা লটারির টিকিট পেয়েছিলেন তাঁর মেয়ে ও স্ত্রী। তাঁরা আর টিকিট কাটতে বারণ করেন। যুবক কথা দিয়েছিলেন, টিকিট কাটা বন্ধ করবেন।পারেননি কথা রাখতে। উল্টে প্রচুর টাকা দেনা করে ফেলেন। মানসিক অবসাদে ডুবে যান। এক দিন বাড়ির মেলে তাঁর ঝুলন্ত দেহ। পরিবারের সদস্যদের অনুমান, ঋণের টাকা শোধ করতে গিয়ে আরও বেশি করে লটারি কাটতেন ওই যুবক। ডুবে যেতেন আরও গভীর ঋণের জালে।
এইগুলি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। লটারির নেশায় অনেকে মানুষই সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। বনগাঁ শহরের বাসিন্দা এক ব্যক্তি ৩০ বছর ধরে লটারির টিকিট কাটছেন। ১ কোটি পাবেন, এমনটাই আশা। ওই ব্যক্তির কথায়, “এক কোটি টাকা পাব মনে যত টিকিট কেটেছি, তাতেই মনে হয় এক কোটি টাকা বেরিয়ে গিয়েছে! পুরস্কার মিলেছে মাত্র কয়েক লক্ষ টাকা!” সব বুঝেও কেন থামতে পারেন না? উত্তর মেলে, ‘‘নেশা হয়ে গিয়েছে!’’
রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন এ ভাবেই বিপদ ডেকে আনছে বহু মানুষের জীবনে। জানা গেল, ঘটি-বাটি তো বটেই, সোনার গয়না, সাইকেল-বাইক বিক্রি করেও কিছু লোক লটারির টিকিট কাটছেন।
হাজার হাজার কোটির আন্তঃরাজ্য লটারি প্রতারণা চক্রের মামলায় ইডি দক্ষিণ ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গে অভিযান চালাচ্ছে। তদন্তকারীদের সূত্রে জানা গিয়েছে, একটি গেমিং সংস্থার অধীনে এ রাজ্যে একটি লটারি অত্যন্ত জনপ্রিয়। ওই লটারির ক্ষেত্রেই এক কর্তার বাড়ি থেকে জালিয়াতির নথি পাওয়া গিয়েছে। পুরস্কারপ্রাপকদের বঞ্চিত করে জালিয়াতির কালো টাকা বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে সাদা করা হয়েছে বলে দাবি তদন্তকারীদের।
ইডি অভিযানের পরে বনগাঁ মহকুমার কিছু লটারি বিক্রেতা লটারি বিক্রি বন্ধ রেখেছেন। কয়েক জন বিক্রেতা জানালেন, বিক্রি কিছুটা কমছে। এক বিক্রেতার কথায়, “আমি তো অনেক দিন ধরেই বুঝতে পারছিলাম, বড় বড় পুরস্কার নিয়ে জালিয়াতি হচ্ছে। লটারি খেলানোর প্রক্রিয়া দেখেও বোঝা যাচ্ছে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে।”
বনগাঁ মহকুমা তথা উত্তর ২৪ পরগনা জেলার খুব কম বাজার এলাকা আছে, যেখানে লটারির দোকান নেই। প্রতিটি স্টেশন চত্বরেও লটারির দোকান আছে। রাস্তার পাশে টেবিল পেতে অনেকে টিকিট বিক্রি করছেন। পায়ে হেঁটে ফেরি করেও টিকিট বিক্রি করতে দেখা যায়। সামান্য পুঁজিতেই লোকজন এই কারবার শুরু করতে পারেন।
রোজ দোকানগুলিতে টিকিট কাটতে বহু মানুষ ভিড় করেন। টিকিট বিক্রি করে অনেকে সংসার চালান। দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সরকারি, বেসরকারি চাকরিজীবী, পুলিশকর্মী, ব্যবসায়ী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও নিয়মিত মোটা টাকার টিকিট কিনছেন। কেউ কেউ দিনে পাঁচ হাজার টাকার টিকিটও কাটেন! দিনমজুর, গরিব মানুষও নিয়মিত টিকিট কাটেন। দিনে ৩০০ টাকা আয় করলে ১২০ টাকা লটারিতে ব্যয় করছেন, এমন মানুষও আছেন। এক দোকানির কথায়, “কেউ এক বার কিছু টাকা লটারিতে পেয়ে গেলে সেই চক্করে পড়ে নিয়মিত টিকিট কাটতে থাকেন।”
এই নেশা থেকে বেরোনো খুবই মুশকিল, জানাচ্ছেন ভুক্তভোগীদের অনেকে।
এ ক্ষেত্রে কী করতে পারে পুলিশ-প্রশাসন? কী বলছে আইন?
পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের কারও কারও মতে, সরকার স্বীকৃত এবং সরকারকে কর দিয়ে যে সব লটারি চলে, সেই টিকিট যাঁরা কাটেন— তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করা যায় না। নিজেদেরই সচেতন হতে হবে, যাতে তাঁরা আসক্ত না হয়ে পড়েন।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী বলেন, ‘‘কর্মহীনতা, মূল্যবৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন মানুষকে দিশেহারা পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষ হঠকারি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। অনেকে লটারির নেশাতেও আসক্ত হয়ে পড়ছেন।"
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy