এখনও উৎসব সাহেবি আদবেই
মেট্রোপলিটন থেকে মফস্সল। ইংরেজি নববর্ষ মানে তো রেস্তরাঁগুলিতে স্পেশ্যাল খানাপিনার আয়োজন। দিনভর পিকনিক অথবা ডে আউট ফেসবুক কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে শুভেচ্ছা বার্তা বিনিময়। সংযোজন ডিজে চালিয়ে রাতভর পার্টি। অনিবার্য কোহলের বন্যা। কিন্তু ডুয়ার্সের নিস্তরঙ্গ চা-বাগান জীবন? সেই সবুজ চা রাজ্যের অন্দরে রয়েছে একাধিক ইউরোপিয়ান ক্লাব। স্বাধীনতার আগে বাগানবাবু থেকে ফ্যাক্টরি ম্যানেজার বেশির ভাগই ছিলেন ইউরোপিয়ান।
ক্লাবগুলি ছিল তাদের মিলিত হওয়ার কেন্দ্র। বিনোদনের ঠিকানা। সাহেবরা আছে, অথচ নিউ ইয়ার সেলিব্রেট হবে না তাই কখনও হয়? ক্রিসমাস থেকেই শুরু হয়ে যেত নববর্ষকে স্বাগত জানানোর আয়োজন। এক সময়কার চা-বাগানের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার আজকের ৮১ বছরের প্রবীণ ব্রজগোপাল দাসের স্মৃতিচারণায়—২৪ ডিসেম্বর বিকেলে কেউ আর অফিসেই আসত না। সপরিবার গাড়ি নিয়ে সটান ক্লাবমুখী হতেন সাহেবরা। বাগানে বড়দিনের ছুটি বরাদ্দ থাকত শুধু মাত্র খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য। বেলা ১১টা নাগাদ ধামসা মাদল সমারোহে নাচতে নাচতে নারী পুরুষ নির্বিশেষে উপস্থিত হতেন ম্যানেজারের বাংলোয়। দুধ দিয়ে ম্যানেজারের পা ধুইয়ে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। ম্যানেজারের হাতে তুলে দেওয়া হত বড়দিনের উপহার কমলালেবু ও ডিমের ঝুড়ি। অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র ম্যানেজার, চা-বাগান সম্পর্কিত বহু গ্রন্থের প্রণেতা রাম অবতার শর্মার কথায়, ‘‘ইংরেজি নববর্ষ উপলক্ষে ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলিতে নিয়ে আসা হত গায়ক-গায়িকা, ইংরেজি ব্যান্ডের দল। থাকত সিনেমা দেখার ব্যবস্থা সঙ্গে অঢেল খাদ্য ও পানীয়। সারা রাত হুল্লোড়ের শেষে যে যার বাগানমুখো হতেন।’’ ব্রিটিশরা দেশ ছেড়েছে বহু দিন। ক্লাবগুলিতে এখনও সাহেব সাহেব গন্ধ। নিউ ইয়ার সেলিব্রেশনের ছবিটা খুব একটা বদলায়নি।
এখন শ্রমিক-কর্মচারীরা ক্রিসমাস ইভের জন্য একটা নির্দিষ্ট দিন চান বাগান কর্তৃপক্ষের কাছে। রঙিন ঝলমলে পোশাক পরে বাচ্চা বুড়োর দল জমায়েত হয় ম্যানেজারের লনে। সেখানে তাঁরা পরিবেশন করেন স্বাগত সঙ্গীত। বাদ যায় না ক্যারলও। সামিল হন সস্ত্রীক ম্যানেজারও। উপহার হিসেবে হাতে তুলে দেওয়া হয় সুদৃশ্য কেক। রানিচেরা বাগানের প্রায় শ’খানেক শ্রমিক-কর্মচারীরা এ ভাবেই পালন করল ক্রিসমাস ইভ। তবে ২৫ নয়, ২৬ ডিসেম্বর। বাদ যায় না চালসা, মিনগ্রাস, লিসরিভার এবং মেটেলি চা-বাগানও। বছর শেষের দিনে ওয়েস্টার্ন ডুয়ার্স ক্লাবে বসেছিল কলকাতা থেকে আগত লাইফ ব্যান্ডের আসর। সেই ছন্দে পা মিলিয়ে ২৪০ জন ক্লাব সদস্য বছরের শেষ শীত সন্ধ্যায় নিজেদের ছেঁকে নিলেন এক বার। বিন্নাগুড়ির সেন্ট্রাল ডুয়ার্স ক্লাবের সদস্যরাও মেতে উঠেছিলেন বর্ষবরণ উৎসবে।—অনিতা দত্ত।
লোক, ধ্রুপদী ও রবীন্দ্রনাথ
‘নৃত্যমল্লিকা’র উদ্যোগে গত ২৬ ডিসেম্বর দীনবন্ধু মঞ্চে হল এক বর্ণাঢ্য শাস্ত্রীয় এবং সৃজনশীল নৃত্য সন্ধ্যা। শুরুতে প্রদীপ জ্বালিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন নৃত্য শিল্পী রুণু ভট্টাচার্য এবং ভারতনাট্যম শিল্পী রাহুল দেব মণ্ডল। প্রধান অতিথি
ছিলেন বিধায়ক রুদ্রনাথ ভট্টাচার্য। ভরতনাট্যম শিল্পী তথা সংস্থার কর্ণধার রিম্পি সাহার পরিচালনায় এ দিন সন্ধ্যায় প্রায় ৭০ জন নৃত্যশিল্পী অংশগ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনৃত্য থেকে শুরু করে শাস্ত্রীয়, লোক নৃত্য, কথক, ভরতনাট্যম এবং সৃজশীল নৃত্যের অনুষ্ঠান। ভারতনাট্যমের তিল্লানা আঙ্গিকের বিশুদ্ধ নৃত্যকে তুলে ধরা হয়। উল্লেখযোগ্য ছিল গোকুলা নিলয়া নৃত্যে শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন রূপকে তুলে ধরার প্রয়াস। যোগ দেন মধুরিমা, অন্বেষা, শ্রুতি, সুমাধা। বিভিন্ন পর্যায়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে নৃত্যের কোলাজ অন্য মাত্রা পায়। নারীর বিভিন্ন রূপ নিয়ে সংস্থার কর্ণধারের সৃষ্টিশীল নৃত্যের পরিবেশনা মুগ্ধ করেছে সকলকেই। রবীন্দ্রনাথের গান এবং কবিতার মেলবন্ধনে ‘উবাচ’র ভিন্ন ধর্মী অনুষ্ঠান ‘এসেছে জ্যোতির্ময়’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে যোগ দেন পারমিতা, সীমারা। লোকগান করেন অনিন্দিতা চট্টোপাধ্যায়। শেষ পর্বে ছিল রাহুল দেব মণ্ডলের ভারতনাট্যম।
কথায় কবিতায়
অন্য রকম ভাবে ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন করল নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন, জলপাইগুড়ি শাখা। কথায়, কবিতায়, স্মৃতিচারণায় জমে উঠেছিল বছরের প্রথম দিনের সন্ধে। বিশ্বায়নের যুগে সাংস্কৃতিক বিভাজনের রেখা স্বাভাবিক ভাবেই ভেঙে যাচ্ছে। এ ভাবেই বৈঠকী আসরের কথামুখ তৈরি করেছেন ড. আনন্দগোপাল ঘোষ। শৈশবের ১ জানুয়ারির স্মৃতিচারণায় ডুব দেন কবি সম্পাদক তনুশ্রী পাল। স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন বিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্তোষ চক্রবর্তী, মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়, চিত্রা পাল ও কেয়া সরকার-সহ আরও অনেকে। বর্নি বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবৃত্তি অন্য আবহ রচনা করে। আধুনিক ও বাউল গানে আসর জমিয়ে দেন সীমা চৌধুরী।
আত্রেয়ীর কবিনামা
স্বপ্ন ভাঙার গান
স্বপ্নহীন যান্ত্রিক সময়ে কবিতার বিষয় হয়ে উঠল ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন আর বিশ্বাসহীনতার যন্ত্রণা। মনোনীতা চক্রবর্তীর কবিতায় প্রতিফলিত হল স্বপ্ন ভাঙার ছবি—‘‘উঠোনের যে ঘোমটা পরা গলিতে সবাইকে এড়িয়ে আমার কথা, গান কবিতা শুনতে/সে মাটি ফুঁড়ে আজ নির্লজ্জের মতো বেরিয়ে এসেছে অন্য কেউ/আমাকে মাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তোমার দৃষ্টি।’’ বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সীমারেখা শাঁওলি দের ‘রাতকথায়’। ইসলামপুরের ‘‘কবিতাজগৎ’’ (সম্পাদনা: গোবিন্দ তালুকদার) পত্রিকার এই সংখ্যায় স্থান পেয়েছে এমনই সব কবিতা। অন্য কবিতাগুলি লিখেছেন তনুশ্রী পাল, বিশ্বনাথ লাহা, তপন রায়প্রধান, ভবেশ বসু এবং সুজাতা পাল-সহ আরও অনেকে। পায়েলি ধরের প্রচ্ছদ প্রশংসার দাবি জানায়।
ফের যাত্রায় মাতল মালবাজার
প্রতিদিন একই শহরে কেউ শিক্ষক, কেউ বিমা কর্মী, কেউ ব্যবসায়ী কেউ আবার শুধুই গৃহবধূর পরিচয়ে বাঁচেন। মনোহর বাহারি রঙে তাঁরাই কেউ হলেন নবাব, সুলতান, পুলিশ আবার নির্যাতিতা নারী। শীতের রাতে যাত্রাপালা দেখার যে আমেজ তাই আবার দীর্ঘ দিন পর ফিরল মালবাজারে। ২৫ এবং ২৭ ডিসেম্বর মালবাজারের কলোনি ময়দানে মা মাটি মানুষ এবং ঐতিহাসিক যাত্রাপালা বন্দি মুসাফির মঞ্চস্থ হয়। ঐক্যতান সঙ্ঘের কর্মকর্তারা জানালেন, ‘মা মাটি মানুষ’ ভৈরবনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ১৯৭৬ সালে তৈরি একটি মঞ্চ সফল যাত্রাপালা। ‘বন্দি মুসাফির’-এ সম্প্রীতির বার্তা দেওয়া হচ্ছে দর্শকদের। যাত্রার অভিনেতা এবং উদ্যোক্তা আনন্দমোহন চক্রবর্তী, সুবীর মিত্র, বিমল দেবনাথদের কথায়, ‘‘নিজের শহরে অভিনয় করার আনন্দটাই আলাদা।’’ আগামী বছরে কী যাত্রা করা যায় তার জন্যও এখন থেকেই ভাবনা চিন্তা শুরু হয়ে গিয়েছে বলে জানালেন সুবীর মিত্র।
জন্মশতবর্ষ
রাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভূপ বাহাদুরের জন্মশতবর্ষ সমাপ্তি উপলক্ষে আয়োজিত হল বিশেষ আলোচনাসভা। বিষয় প্রজাবৎসল রাজার জীবন ধর্ম ও সাধনা। আয়োজক জগদ্দীপেন্দ্রনারায়ণ ভূপ বাহাদুর জন্মশতবার্ষিকী কমিটি, কোচবিহার। কোচবিহারের জেলা ও দায়রা জজ পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্যে উঠে আসে কোচবিহারের রাজাদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার চর্চার প্রয়োজনীয়তার কথা। ড. আনন্দগোপাল ঘোষ আলোচনায় জানান, শেষ মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্রকে নিয়ে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কম অথচ ভারতের রাজনৈতিক ঝঞ্ধামুখর সময়ের সাক্ষী তিনিই।
ঋত্বিকের ‘মাসান’
দীর্ঘ লালিত বিশ্বাস ও সংস্কারের ভিত্তিতে নানা লোকদেবতার জন্ম হয়েছে। তেমনই হল ‘মাসান’। ইন্দো-মঙ্গোলয়েড শ্রেণির অনেক গোষ্ঠীই মাসান দেবতার লোকাচারে বিশ্বাস করে থাকেন। তবে কোচ-রাজবংশী জনগোষ্ঠীই প্রধানত মাসান পূজার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক বলে মনে করেন গবেষকরা। ধীরে ধীরে সেই লোকদেবতার ছবি তৈরি হয়। তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে মাসান শিল্প। একটা সময়ে উদ্বাস্তু রাজবংশী জনগোষ্ঠীর হাত ধরে দেবদেবী ও পশুর অবয়ব কল্পনা করে প্রায় দু’শো ‘মাসান’ লোকদেবতা তৈরি হয়ে যায়। সেই মাসান শিল্পীদের উপরে লেখা নাটক ‘মাসান, দ্য কর্ক ডল নাটকটি মঞ্চস্থ করল শিলিগুড়ির ঋত্বিক নাট্য সংস্থা। মাসানের রূপভেদ নিয়ে নানা মত রয়েছে। কেউ বলেন ১৬টি, কেউ বলেন ১৮টি। সেই ‘মাসান’ শিল্প নিয়ে চর্চায় রত অনেকেই। তবে আগের তুলনায় আগ্রহীদের সংখ্য কম। নাটকের পরতে পরতে সেটা তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে। কী ভাবে ও কেন মাসানের প্রতি বর্তমান প্রজন্মের অনীহা তাও স্পষ্ট হয়েছে। তবে তার চর্চা সমাদর পাচ্ছে নিঃসন্দেহে। যেমন, জলপাইগুড়ির শিল্পী নীহার মজুমদার মাসান নিয়ে ছবি আঁকার সুবাদে দেশে-বিদেশে সমাদৃত হয়েছেন। তা নিয়ে বাংলাদেশেও চর্চা হচ্ছে। তবে লুপ্তপ্রায় লোক শিল্প নিয়ে ঋত্বিকের নাট্য প্রযোজনা যে সাহসী তা নিয়ে সন্দেহ নেই। সঙ্গীত মানানসই। তুলনায় মঞ্চ পরিকল্পনা যথেষ্ট পেশাদারিত্বের পরিচায়ক। আলোর ব্যবহার চমৎকার। নাটকে দলগত অভিনয় অত্যন্ত জোরাল। তবে শিশু শিল্পী কৃষ মজুমদারের নাম আলাদা করে উল্লেখ করতেই হয়। নাট্যকার, নির্দেশক সাধন চক্রবর্তীর প্রচেষ্টা নাট্যপ্রেমীদের সমাদর পাবে বলেই মনে হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy