আদালত থেকে বেরোচ্ছেন বংশীবদন বর্মন। —নিজস্ব চিত্র।
এখনও সেদিনের কথা মনে পড়লে চমকে যান পুলিশকর্মীদের অনেকেই। কোনও মতে বেঁচে ফিরেছিলেন অনেক পুলিশকর্মী। তাঁদের অনেকেই এখন চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন।
সে দিনের কথা ভোলেননি কোচবিহারের মানুষও। সে দিন সকাল থেকেই শহর ছিল উত্তাল। প্রায় সব মোড়েই উত্তেজনা ছিল। তারপরে গ্রেটার সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের খণ্ডযুদ্ধ ঘটেছে চোখের সামনে। এরপরে বেশ কয়েকদিন ধরেই শহরে সেই উত্তেজনা জিইয়ে ছিল। তাই দশ বছর কেটে গেলেও গ্রেটার মামলার রায় কী হবে, তা নিয়ে উৎসাহ ছিল সাধারণ মানুষেরও। সারা দিনই শহরের নানা জায়গায় দেখা গিয়েছে এই রায় নিয়ে আলোচনা হতে।
সে দিন যে পুলিশকর্মীরা রাস্তায় নেমেছিলেন, তাঁদের কেউ কাজ করছেন কোচবিহারেরই কোনও থানায়। শুক্রবার গ্রেটার কোচবিহার মামলার রায় শোনার জন্য উৎসুক হয়ে ছিলেন তাঁরা। রায় শুনে কেউ কোনও রা কাড়েননি। তবে তাঁদের মুখগুলো অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়েছিল। কোচবিহারের জেলা জজ রবীন্দ্রনাথ সামন্ত রায়ে উল্লেখ করেন, সেদিন ২ পুলিশ কর্মী এবং এক আইপিএস অফিসারের মৃত্যু অত্যন্ত বেদনাদায়ক। যা আমাকে বেদনা দিয়েছে। কিন্তু, এই অভিযুক্তরাই যে ঘটনায় যুক্ত ছিলেন, তা প্রমাণ করতে পারেনি সরকার।
এই বেদনার কথা শুনে চোখে জলও চলে আসে কোচবিহারে কর্মরত এক পুলিশ অফিসারের। তিনি ওই দিন চকচকাতেই কর্তব্যরত ছিলেন। তিনি বলেন, “রাস্তা থেকে অনশন তুলতে গেলেই গণ্ডগোল ছড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার লোক। আমরা কয়েক জন পুলিশকর্মী। আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন কিছু মানুষ। কোনও কথা শুনছিল না। চোখের সামনে কয়েকজন সহকর্মী লুটিয়ে পড়লেন। ভয়ে লুকিয়ে পড়েছিলাম। তাই প্রাণে বেঁচেছি।” অবসরপ্রাপ্ত এক পুলিশ আধিকারিক জানান, তিনি এখনও একা থাকলে মনে পড়ে ওই দিনের কথা। তিনি বলেন, “মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। চোখের সামনে আমাদের সহকর্মী এক অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে মারধর করা হয়। দু’জনকে চোখের সামনে মেরে ফেলা হয়। অত মানুষের মধ্যে কিছু করতে পারলাম না। তা আমাকে খুব কষ্ট দেয়।”
কী হয়েছিল ওইদিন? ২০০৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পৃথক রাজ্যের দাবিতে কোচবিহার জেলাশাসকের দফতরের সামনে অনশন আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশনের নেতা বংশীবদন বর্মন। ওই দিন থেকে সকাল থেকে হাজার হাজার গ্রেটার কর্মী-সমর্থক মিছিল নিয়ে পায়ে হেঁটে জেলাশাসকের দফতরের দিকে এগোতে শুরু করে। পুলিশ গণ্ডগোলের আশঙ্কা করে আগাম ওই আন্দোলন রুখতে তৎপর হয়ে ওঠে। জেলার বাইরে থেকেও নিয়ে আসা হয় প্রচুর পুলিশকর্মী। বিভিন্ন রাস্তায় পুলিশ টহলদারি শুরু করে। কোচবিহারে ঢোকার আগেই রাস্তায় রাস্তায় আটকে দেওয়া গ্রেটারকর্মীদের। কয়েক হাজার কর্মীকে গ্রেফতারও করা হয়। ভেটাগুড়িতে পুলিশের বাধা পেয়ে অবস্থানে বসে গ্রেটার কর্মীরা। খাগরাবাড়ি এবং চকচকাতেও ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে অনশনে বসে পড়েন গ্রেটারকর্মীরা। দিনভর এমন ভাবে চলার পর বিকেলের দিকে পুলিশ পাকা রাস্তা থেকে গ্রেটার কর্মীদের সরে যাওয়ার জন্য আবেদন করতে থাকে।
তা নিয়েই শুরু হয় বচসা। প্রথম গণ্ডগোল শুরু হয় খাগরাবাড়িতে। পুলিশের সঙ্গে খন্ডযুদ্ধ শুরু হয় গ্রেটারকর্মীদের। অভিযোগ, পুলিশের গুলিতে দুই গ্রেটার কর্মী বিষাদু বর্মন এবং চিত্ত রায়ের মৃত্যু হয়। ওই খবর ছড়িয়ে পড়তেই আধ ঘন্টার ব্যবধানে গণ্ডগোল শুরু হয় চকচকায়। পুলিশ রিপোর্টেই জানা গিয়েছে, সেই সময় চকচকাতে আন্দোলনকারীর সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজারের বেশি। সেখানে পুলিশ ছিল হাতে গোনা।
দুই পক্ষের সংঘর্ষে তেতে ওঠে চকচকা। পুলিশকর্মীদের লক্ষ্য করে ইট বৃষ্টি শুরু হয়। অভিযোগ, পুলিশকর্মীদের ধরে মারধরও করা হয়। ঘটনাস্থলেই দুই পুলিশ কর্মী যোগেশচন্দ্র সরকার (৪৭) এবং গৌরচন্দ্র ধর (৫০)-এর মৃত্যু হয়। কালিম্পংয়ের অতিরিক্তি পুলিশ সুপার আইপিএস মুস্তাক আহমেদকে (৫০) ওই এলাকার পরিস্থিতি সামলানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁকেও মারধর করার অভিযোগ ওঠে। হাসপাতালে ভর্তি করানো হলে সে দিনই রাতে মৃত্যু হয় ওই পুলিশকর্তার। ঘটনার সময় পুলিশের বিরুদ্ধেও লাঠি চালানো, কাঁদানে গ্যাস ছোড়া এবং গুলি চালানোর অভিযোগ ওঠে।
পুলিশ দাবি করেছিল, একটি সাদা গাড়িতে করে বংশীবদনবাবু এবং জোতিষ সরকার চকচকায় যান। তাঁদের উস্কানিতেই মারমুখী হয়ে ওঠেন গ্রেটারকর্মীরা। খুন করা হয় পুলিশকর্মীদের। বিচারক এদিন রায়ে জানান, কিন্তু ওই গাড়ির চালক সাক্ষ্য দিয়ে জানিয়েছিলেন, তাঁর গাড়ি আটকে দেওয়া হয় ভেটাগুড়িতেই। ওই দু’জন তাঁর গাড়িতেই ছিলেন। কী করে তা হলে তাঁরা উস্কানি দিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে আদালতে।
শুধু তাই নয়, ওই অত মানুষের মধ্যে কারা পুলিশকর্মীদের খুন করেছে, সে ব্যাপারেই কোনও তথ্য প্রমাণ হাজির করতে পারেনি প্রশাসন। যাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছিল তাঁরা যে খুনে জড়িত ছিল, সে সংক্রান্ত কোনও তথ্য দিতে পারেননি তাঁরা। এক পুলিশকর্মী আফসোস করে বলেন, “যারা কর্তব্যরত পুলিশকর্মীদের খুন করেছিল তাঁরা চিহ্নিত হবেন, এটুকু আশা করেছিলাম।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy