(বাঁ দিকে) হামলায় ভাঙচুর করা হয় ব্যবসায়ীদের বাড়ি। (ডান দিকে) কান্নায় ভেঙে পড়েছেন এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী। ছবি: অমিত মোহান্ত।
মাছের ওজনে কারচুপির অভিযোগ। তার জেরে মাছ ব্যবসায়ীদের বাড়িতে অবাধে তাণ্ডব। বৃহস্পতিবার সকালে এমন ঘটনারই সাক্ষী রইল দক্ষিণ দিনাজপুরের তপনের লস্করহাট।
দল বেঁধে খুচরো মাছ পাইকারদের ১১টি বাড়ি এবং দুটি আসবাব তৈরির দোকানে ভাঙচুরই শুধু নয়, জনতার রোষ থেকে রেহাই পায়নি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা চারটি ছোট গাড়ি ও একটি মোটরবাইকও। তির-ধনুক, বল্লম, কুড়ুল, রামদা নিয়ে হামলাকারী বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে লুঠপাটের অভিযোগও উঠেছে। সশস্ত্র পুলিশের সামনে প্রায় একঘণ্টা ধরে পর পর দুটি পাড়ায় চড়াও হয়ে বেছে বেছে মাছ বিক্রেতাদের বাড়িতে তাণ্ডবের ঘটনায় এলাকার বসিন্দারা ক্ষোভে ফুঁসছেন। হামলাকারীদের গ্রেফতার ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে পাল্টা আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন এলাকার বাসিন্দারা। হামলার সময় পাইকারেরা পালিয়ে যাওয়ায় রক্তপাতের কোনও ঘটনা ঘটেনি। তবে বাড়িগুলির স্টিল আলমারি, টিভি, ঘরের দরজা, জানালা সহ যাবতীয় আসবাবপত্র, বাথরুম, টিনের ছাউনি ও বেড়া ভাঙচুরের সময় নিজেদের ধারালো অস্ত্র ছিটকে চার জন হামলাকারীই জখম হন বলে জানা গিয়েছে। তাদের বালুরঘাট হাসপাতাল ভর্তি করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রের খবর, এ দিন লস্করহাটের হাটখোলায় স্থানীয় কাঁকনা এলাকার খুচরো মাছ ব্যবসায়ী বিরজু হাঁসদা ওরফে ধারু ২০ কেজি মাছ হাটে নিয়ে এলে পাইকারী ব্যবসায়ী তাপস বিশ্বাস এবং ইন্দ্রজিৎ রায়দের সঙ্গে ওজন নিয়ে বিবাদের সূত্রপাত হয়। ধারু অভিযোগ করেন, ‘‘২০ কেজি মাছ ওজন করে হাটে নিয়ে আসি। অথচ ওই পাইকারেরা ওজন করে বলেন ১৫ কেজি মাছ রয়েছে। এরপর ফের হাটের অন্য এক ওজন পরিমাপ যন্ত্রে মেপে দেখি মাছের ওজন ২০ কেজি-ই আছে।’’ পাইকারদের বিরুদ্ধে ঠকানোর অভিযোগ তুলে সরব হলে ধারুকে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। এরপর হাট থেকে ফিরে গিয়ে প্রহৃত ধারু পরিচিত কয়েকজনকে নিয়ে ফের হাটে গিয়ে ওই পাইকারদের খোঁজ করে পাননি। এরপর এলাকায় ফিরে গিয়ে ঘটনার প্রতিবাদে গাছের ডাল ঘুরিয়ে তারা পাইকারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।
সকাল ১০টা থেকে ওই এলাকার পারিলা, এরেন্দা, কাঁকনা, কাঁঠালপুকুর, খলসী, মল্লিকপুর, বেড়াকুঠি-সহ আশপাশের প্রায় ২০টি গ্রাম থেকে ডুগডুগি বাজিয়ে হাতে তির-ধনুক ও লাঠিসোঁটা নিয়ে হাজার খানেক বাসিন্দা লস্করহাট এলাকায় চড়াও হন বলে অভিযোগ। হাটখোলা এলাকার পাইকারি মাছ ব্যবসায়ী তাপস মণ্ডল, ইন্দ্রজিৎ রায়, কান্ত বিশ্বাস, সুশীল সরকার, দুলাল বিশ্বাস, কালীদাস সিকদারদের বাড়িতে চড়াও হয়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়ে তছনছ করে দেয়। আতঙ্কিত ইন্দ্রজিৎ রায়ের স্ত্রী সরস্বতীদেবী বলেন, ‘‘সে সময় ১০ বছরের ছেলেকে খাওয়াচ্ছিলাম। দলটি দরজা ভেঙে ঘরের আলমারি শো-কেস টিভি গুঁড়িয়ে দিয়ে চার ভরি সোনার গয়না লুঠ করে।’’
এরপর দলটি খড়মডাঙা এলাকায় হানা দিয়ে উদয় সরকার, কান্ত বিশ্বাসের ফার্ণিচার ও আলমারি তৈরির দুটি দোকান সমেত পর পর তাদের বাড়িতে ভাঙচুর করে চলে যায়। সুশীল সরকার, কান্ত বিশ্বাস, দুলাল বিশ্বাসদের অভিযোগ, র্যাফ ও পুলিশের বিরাট বাহিনীর চোখের সামনেই উন্মত্ত দলটি তাণ্ডব চালিয়ে গেলেও পুলিশ ছিল নীরব দর্শক। ওজনে কারচুপি ও ওই ব্যবসায়ীকে মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পাইকারেরা। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘মিথ্যা অভিযোগ তুলে আমাদের চোর বলে অপপ্রচারের চেষ্টার প্রতিবাদ করেছিলাম। তাতে দলবেঁধে আচমকা ওরা হামলা চালাবে ভাবতে পারিনি। আমাদের চরম ক্ষতি হয়েছে। তাই ক্ষতিপূরণ দিক প্রশাসন।’’
প্রায় এক ঘণ্টা তাণ্ডবের পরে গোটা তপন এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। হামলাকারীরা লস্করহাটের পাশে কাঁকনা এলাকার মাঠে জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠতে পারে আশঙ্কা করে প্রশাসনের তরফে খবর দেওয়া হয় তপনের বিধায়ক তথা উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী বাচ্চু হাঁসদাকে। বেলা ১২ টা নাগাদ মন্ত্রী বাচ্চুবাবু এলাকায় গিয়ে ওই দলের নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলার পর উত্তেজনা কমে। পরে বাচ্চুবাবু বলেন, ‘‘আমরা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি।’’ জেলা পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ বলেন, ‘‘ঘটনা খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরু হয়েছে। এলাকায় পুলিশ পিকেট বসানো হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।’’ বিকেলে ঘটনাস্থলে যান তৃণমূল নেতা তথা বিধানসভার পরাজিত প্রার্থী সত্যেন রায়। জেলা কংগ্রেস সভাপতি নীলাঞ্জন রায়কে নিয়ে লস্করহাটে যান এলাকার কংগ্রেস বিধায়ক গৌতম দাস। তিনি উপস্থিত দলীয় কর্মী-সমর্থকদের কাছে ডেকে ঘটনাটিকে নিয়ে রাজনীতি না করার বার্তা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy