Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

জঙ্গলপথ ব্যবহার নিয়ে তপ্ত জলদাপাড়া

ক্ষোভ জমছিল প্রায় বছরখানেক ধরেই। বুধবার সেই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটল। জঙ্গলপথ ব্যবহার নিয়ে জলদাপাড়া লাগোয়া বন-গ্রামের বাসিন্দা ও বন দফতরের বিবাদের জেরে পুড়ে ছাই হল বন বাংলো। এ দিন দুপুরে জলদাপাড়া বন দফতরের অফিস চত্বরে বন দফতরের তিনটি গাড়ি-সহ অফিস ও বনকর্মীদের বাড়িতে চড়াও হয়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় ক্ষুব্ধ জনতা। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় বন দফতরের একটি বাংলোয়।

জ্বলছে বন দফতরের বাংলো। জলদাপাড়ায়। ছবি: রাজকুমার মোদক।

জ্বলছে বন দফতরের বাংলো। জলদাপাড়ায়। ছবি: রাজকুমার মোদক।

নিলয় দাস
জলদাপাড়া শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৪ ০১:৫০
Share: Save:

ক্ষোভ জমছিল প্রায় বছরখানেক ধরেই। বুধবার সেই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটল। জঙ্গলপথ ব্যবহার নিয়ে জলদাপাড়া লাগোয়া বন-গ্রামের বাসিন্দা ও বন দফতরের বিবাদের জেরে পুড়ে ছাই হল বন বাংলো।

এ দিন দুপুরে জলদাপাড়া বন দফতরের অফিস চত্বরে বন দফতরের তিনটি গাড়ি-সহ অফিস ও বনকর্মীদের বাড়িতে চড়াও হয়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় ক্ষুব্ধ জনতা। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় বন দফতরের একটি বাংলোয়। ভোটের আগে এই ঘটনার পিছনে ‘রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের’ সন্দেহ করেছেন রাজ্যের বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মন। তাঁর কথায়, “আইন অনুযায়ী জঙ্গলের রাস্তা কোনও ভাবে বাইরের কেউ ব্যবহার করতে পারে না। তবে ভাঙচুর, মারধর, বন বাংলোটি পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা মানা যায় না। কেন এমন পরিস্থিতি হন তা তদন্ত করে দেখা হবে। এর পিছনে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।”

বাসিন্দারা জানান, জলদাপাড়া রেঞ্জ অফিসের পাশে আলিপুরদুয়ার-১ নম্বর ব্লকের তিনটি পঞ্চায়েত এলাকা রয়েছে। সেখান থেকে জঙ্গলের ছ’কিলোমিটার পথ দিয়ে আধঘণ্টায় মাদারিহাট ও ৪৫ মিনিটের মধ্যে বীরপাড়া যাওয়া যায়। কৃষকেরা ওই পথে মাদারিহাট থেকে ভুটানে সব্জি বিক্রি করতে যান। বীরপাড়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় রোগীদের। ছাত্রছাত্রীরা ওই রাস্তা ধরে মাদারিহাটের স্কুলে যায়।

এমনিতেই সংরক্ষিত বনাঞ্চল, যেখানে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীদের বাস, তার মধ্য দিয়ে চলাচল আইনবিরুদ্ধ। তার উপর দু’বছর আগে জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের স্বীকৃতি পায়। তার পরে ওই পথে চলাচলের উপর নিয়ন্ত্রণ আরও বাড়ে। মাস ছ’য়েক আগে বন দফতরের কাউন্টার থেকে মোটরবাইকের জন্য ২৫ টাকা এবং হেঁটে ও সাইকেলে যাতায়াতের জন্য ২০ টাকা ধার্য করা হয়। তবে বনবস্তির মানুষের স্বার্থেই এক মাস পর তা কমিয়ে মোটরবাইকের জন্য ১০ টাকা এবং হেঁটে ও সাইকেলে যাতায়াতের জন্য ২ টাকা করা হয়।

বিবাদের সূত্রপাত হয় সোমবার। বাসিন্দাদের অভিযোগ, ওই দিন বনবস্তির বাসিন্দা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী এক ছাত্র জঙ্গলের রাস্তা ধরে মাদারিহাট যাওয়ার সময় এক রেঞ্জ অফিসার তাকে মারধর করেন। ওই ছাত্রের কাছ থেকে জরিমানা হিসাবে ১১০০ টাকা করা হয়। সে পরীক্ষাও দিতে পারেনি বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ। মঙ্গলবার থেকে ওই বনপথে যাতায়াত পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় বন দফতর। এলাকাবাসীরা বৈঠক করে জলদাপাড়া পূর্ব ও পশ্চিম রেঞ্জ অফিসের সামনে অনশনে বসার পরিকল্পনা নেন। বৈঠকে কংগ্রেস ও সিপিএম-এর কিছু স্থানীয় নেতা ছিলেন বলে বাসিন্দারা জানান। কিন্তু তাঁরাই কি এই ঘটনায় ইন্ধন জুগিয়েছেন?

গোয়েন্দা সূত্র অন্য কথা বলছে। রাজ্য গোয়েন্দা দফতরের এক পদস্থ কর্তা জানান, এর পিছনে থাকতে পারে জঙ্গি-যোগও। জলদাপাড়ার পশ্চিম দিকের কম্পার্টমেন্টে কিছু গ্রাম আছে। তার মধ্যে শালকুমার অন্যতম। তিনি বলেন, “২০০২-এর আগে পর্যন্ত ওই গ্রামটি ছিল কেএলও-র শক্ত ঘাঁটি। জলদাপাড়া অভয়ারণ্যে গণ্ডার নিধন থেকে কাঠ চোরাইয়ে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল ওই গ্রামের একাংশের বিরুদ্ধে। বহু বার অভিযানও চালিয়েছি।”

বন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০২ থেকে ওই গ্রামে ‘শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া’ শুরু করে বন দফতর। দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “জঙ্গিদের আনাগোনা রুখে বাসিন্দাদের মূল স্রোতে ফেরাতে আমরা তাঁদের মধ্যে ভ্যান রিকশা বিতরণ করেছি। যাতে তাঁরা দূরের গ্রামে সব্জি বিক্রি করতে পারেন। অনেককে সাইকেলও দেওয়া হয়েছে।” বন দফতরের প্রবেশ মূল্যের ২৫ শতাংশও ওখানে বিলি করা হত এতদিন।

তবে বছর খানেক আগের ট্রেজারি আইনের ফাঁদে পড়ে হাতি-সহ অন্য বন্য জন্তুদের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে বছর ঘুরে যাচ্ছে। আগে যে টাকা ডিএফও-র নির্দেশে রেঞ্জ অফিসারেরাই বিলি করতে পারতেন, এখন তা পেতে বাসিন্দাদের ট্রেজারি যেতে হয়। তাতে দীর্ঘদিনেও টাকা তাঁরা পান না। বাসিন্দাদের এই ক্ষোভকে ব্যবহার করে কেএলও ফের এলাকায় জমি খুঁজছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে খবর।

বুধবার সকাল সাড়ে আটটা থেকে প্রায় দুই হাজার বাসিন্দা রেঞ্জ অফিসের সামনে জড়ো হতে শুরু করেন। আচমকা তীঁরা লোহার গেট ভেঙে বন দফতরের রেঞ্জ অফিস চত্বরে ঢুকে পড়েন। রেঞ্জ অফিসারের আবাসনে ও দু’টি অফিসে হামলা চালানো হয়। অফিসারদের গালিগালাজ, মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। তার পরে তিনটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। খবর পেয়ে জলদাপাড়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট ওয়াইল্ড লাইফ ওয়ার্ডেন শ্বেতা রাই এলে তাঁকে গাড়ি থেকে নামিয়ে গাড়িটি ভাঙচুর করা হয়। অভিযোগ, ওই মহিলা অফিসারকে চুলির মুঠি ধরে মারধর করা হয়। বেলা ১১টা নাগাদ মাদারিহাট,আলিপুরদুয়ার ও হাসিমারা থানা থেকে পুলিশ কর্মী ও র্যাফ আসে। কথা চলার ফাঁকেই উত্তেজিত জনতা আচমকা জঙ্গল লাগোয়া বন দফতরের কাঠের তৈরি বাংলোয় আগুন ধরিয়ে দেয়। ঘটনাস্থলে দমকল থাকলেও মাত্র ১০ মিনিটে ভস্মীভূত হয় কাঠের বাংলোটি।

এ দিন বিকেল পাঁচটা নাগাদ জলদাপাড়ার ডিএফও রাজেন্দ্র জাখর ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিষয়টি নিয়ে আগামী শনিবার বৈঠকে বসার কথা জানালে গ্রামবাসী শান্ত হন। এলাকায় পুলিশ পিকেট বসিয়ে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যদিও রাত অবধি কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি বলে আলিপুরদুয়ারের এসডিপিও বিশ্বচাঁদ ঠাকুর জানিয়েছেন। তবে উত্তরবঙ্গের মুখ্য বনপাল (বন্যপ্রাণ) বিপিন সুদ কেন ঘটনাস্থলে যাননি প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও। তিনি অবশ্য বলেন, “জাতীয় উদ্যানের মধ্যে দিয়ে এ ভাবে চলাচল করা যায় না। আমরা তাও টিকিটের ব্যবস্থা করে যাতায়াতের অনুমতি দিয়েছিলাম। বাসিন্দারা এমন করবেন তা ভাবা যায় না। পুলিশে অভিযোগ জানানো হচ্ছে।”

অন্য বিষয়গুলি:

jaldapara commoners forest department clash
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE