মহানন্দার উপরে অসম্পূর্ণ সেতু। এই সেতুটি তৈরি হলে জাতীয় সড়কের বাইপাস দিয়ে যাতায়াতের সুবিধা হবে। —নিজস্ব চিত্র।
এখন যেখানে ‘শুভাঙ্গন’, ‘হেমাঙ্গন’ ‘মৈত্রেয়ী’ এমন সব নামের বহুতলেরা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেখানে বছর ষাটেক আগে চিতাবাঘের পাল্লায় পড়েছিলেন কমল বসাক। “এখন যেখানে ১ নম্বর কলোনি, ৩ নম্বর কলোনি, মালঞ্চপল্লি, কৃষ্ণপল্লি, সেগুলো তখন ছিল ঘন জঙ্গল। সেই জঙ্গলে চিতাবাঘ দাপিয়ে বেড়াত,” বললেন বছর পঁচাত্তরের কমলবাবু। পেশায় ছিলেন গ্রন্থাগারিক। নেশা স্থানীয় ইতিহাস চর্চা। “একদিন চিতাবাঘের মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিলাম। একটা পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে কোনও মতে বেঁচেছি। ভাবলে আজও গায়ে কাঁটা দেয়।”
চিতাবাঘের সেই বিচরণক্ষেত্র আজ মালদহ শহরের অভিজাত এলাকায় পরিণত হয়েছে। গজিয়ে উঠেছে শহরের সবচেয়ে বেশি বহুতল বাড়িগুলি। তিন-সাড়ে তিন হাজার টাকা বর্গফুটের কমে ফ্ল্যাটা মেলে না। সমৃদ্ধির চেহারা চারদিকে, কিন্তু শহরবাসী আছেন ধন্দে। সেই ইংরেজ আমলে কি ভাল ছিল শহর? নাকি এখন?
কলকাতা গড়ে ওঠার সঙ্গে মালদহ শহর গড়ে ওঠার ইতিহাসে কিছু মিল রয়েছে। ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির টমাস হেঞ্চম্যান জমিদার রাজা রায়চৌধুরীর কাছে থেকে ৩০০ টাকার বিনিময়ে কুতুবপুর, হায়দারপুর ও সিঙ্গাতালো (বর্তমানে সিঙ্গাতলা) এই তিনটি জায়গা কিনেছিলেন। এরপর ধীরে ধীরে একের পর এক এলাকা কিনতে শুরু করে সাহেবরা।
মুকদমপুরে প্রথম কুঠি তৈরি করে ইংরেজদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। পরে বর্তমানে যেখানে জেলা পুলিশ সুপার অফিস সেই অফিসই ছিল কোম্পানির কুঠি। সেই কুঠিতেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মালদহে তৈরি বুলবুল চশম, শবনম, বাবতা, মসলিন কাপড়ের মতো ৩০ ধরনের কাপড় রং (ডায়িং) করত। সেই কাপড় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ও সাগরপাড়ে রফতানি হত। ওই কুঠিকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল রং-রেজা বাজার।
সেই বাজার কবে ইংরেজবাজার বলে পরিচিত হয়ে উঠল, জানে না কেউ। তবে ইংরেজবাজারে অবশ্য ইংরেজদের চেয়ে প্রথমে বেশি প্রভাব ছিল ইউরোপের অন্য দেশগুলির। পুরাতন মালদহে বস্ত্রশিল্প সেই সময়ে সবাইকে আকৃষ্ট করে। সেই বস্ত্রের আকর্ষণে ১৬৬৫ সালে পুরাতন মালদহে প্রথম পর্তুগিজ কোম্পানি ঘাঁটি তৈরি করে। ধীরে ধীরে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, আর্মেনিয়ান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ফরাসিদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পুরাতন মালদহে বস্ত্রের ব্যবসা শুরু করে।
সেই সময় পুরাতন মালদহের শাড়ি পটনা, সুরাট হয়ে সাগরপাড়ে যেতে শুরু করে। পুরাতন মালদহের শাড়ি দেখে তখন আকৃষ্ট হয় ব্রিটিশরাও। ১৬৬৫ সালেই ইংরেজ ফেচ নিধান পুরাতন মালদহে আসেন। তাঁর রিপোর্ট পাওয়ার পরই ইংরেজদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পুরাতন মালদহে বস্ত্রের ব্যবসা করতে আসে। কিন্তু অন্য কোম্পানির দাপটে ইংরেজদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেখানে ব্যবসা করতে না পেরে মহানন্দা নদী পেরিয়ে এপারে ঘাঁটি গেড়ে রং-রেজা বাজার গড়ে তোলে। সেই সময় মালদহ শহরে কতুবপুর, হায়দরপুর, সিঙ্গাতলা, মুকদমপুরের বসবাস শুরু হয়েছিল।
ইংরেজদের হাতে গড়া মালদহ শহরে সেই সময় শহরের নিকাশি ব্যবস্থা মহানন্দার উল্টো দিক শহরের পশ্চিম দিকে প্রবাহিত ছিল। তখন মহানন্দার জল টলটল করত। ভাত রান্নাও করা যেত সেই জলে। এখন শহরের যাবতীয় নিকাশি নালা যেন মহানন্দাকে দূষিত করার জন্যই ধেয়ে যাচ্ছে। অন্তত ৫০-৬০টি নিকাশি নালা শেষ হচ্ছে মহানন্দায়। নদীর জল পচে গিয়েছে। চান করাও যায় না। পাবদা, ট্যাংরা, মৌরলার মতো মাছ হারিয়ে যাচ্ছে মহানন্দা থেকে।
উপরন্তু, সামান্য বৃষ্টিতেই মালদহ শহরের ২৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২০টি ওয়ার্ডই জলমগ্ন হয় পড়ে। উপরি পাওনা মিলেছে যানজট। রথবাড়িতে চার লেনের ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের দুই লেন আটকে ট্যাক্সি, ম্যাক্সি ট্যাক্সির স্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। সেই বেআইনি স্ট্যান্ড সরাতে পুরসভা ও জেলা প্রশাসন নীরব বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের। তিন বার শিলান্যাস করার পরেও আজও চালু হয়নি কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাস। ১০ বছর ধরে মালদহ শহরের মানুষ কিন্তু শুনছে কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাসের কাজ শেষের পথে, শীঘ্রই চালু হবে।
টার্মিনাস যেমন চালু হয়নি, তেমনই ডাম্পিং গ্রাউন্ডও হয়নি। কোথায় জঞ্জাল ফেলা হবে সেটা পুরসভা ঠিক করতে পারেনি। কখনও জাতীয় সড়কের ধারে, কখনও সাহাপুরে, কখন বাগবাড়িতে জঞ্জালের স্তূপ দেখা যায়। সর্বত্রই সাফাইকর্মীরা বাসিন্দাদের রোষের মুখে পড়ছেন। এখন ইংরেজবাজার নিয়ন্ত্রিত বাজারের নিচু জমিতে শহরের জঞ্জাল ফেলছে পুরসভা। তাতে কিছুদিন চলতে পারে। কিন্তু আগামী দিনে জঞ্জাল কোথায় ফেলা হবে, তা নিয়েই উদ্বিগ্ন পুরসভা-প্রশাসন।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy