অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘কোথায় এসে দাঁড়ালাম’ (৫-১১) প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গ বহুকাল পরে এক নবনির্মাণের রাজনীতি দেখল যা এক অন্য মাত্রা এনে দিল। আমাদের যে স্বাভাবিক নিয়মে নাড়াচাড়া করে এগোনো উচিত, সেটাই আমরা ভুলে গিয়েছিলাম। সেই স্থবিরতার গোড়ায় এই তিন মাসে কেউ যেন কুঠারাঘাত করল। চোখ কচলে আত্মস্থ হয়ে দেখলাম আশপাশের কয়েকটি ‘শিশু’ সামনের দিকে এগোচ্ছে। দীর্ঘ দিন নড়াচড়া না করার ফলে নজরে পড়ল, কারও কারও মেরুদণ্ড সোজা নেই বলে ঝুঁকে আছে। আবার কারও শরীরে শিরদাঁড়া তো দূরের কথা, কাপড়টুকুও নেই। সেই শিশুরা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে সরবে বলে উঠল, রাজা তোর কাপড় কোথায়?
আর এই সহজ সত্যটাকে গুলিয়ে দেওয়ার জন্য কেউ কেউ বলল, কী আর হল? কেউ কেউ বোঝাতে চাইল, ওই ‘কানাগলি’তে সব হারিয়ে গেল। আসলে তারা জ্ঞানপাপী। তারা দেখেছে নিজ নিজ এবং সামগ্রিক ভাবে ছোট বড় অনেক অবিচারের ঘা খেতে খেতে ‘উঁচু-নিচু’ সব ক্ষেত্রের মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে রাস্তায় নেমে এসেছিল, শুধুমাত্র নিজেদের বিবেকের ডাকে। তুলে নিয়েছিল নাম না-জানা, সর্বসমক্ষে দেখতে না-পাওয়া এক প্রতিবাদের পতাকা। তারা দিনে-রাতে বোঝাচ্ছিল শুধু আর জি কর নয়, গোটা সমাজজীবনে যা চলছে তার সঙ্গে মনুষ্যত্বের কোনও যোগাযোগ নেই। তারা এইগুলি বোঝাচ্ছিল এক অন্য ধারায়, পরিচিত ছকের বাইরে। তাই শাসক তো বটেই, বিরোধীদের কম বেশি নিশানায় থেকেছে তারা। কারণ একটাই, এ রকম ভাবে নগদ কিংবা ডিম-ভাতের লোভ ছাড়া এত মানুষ একেবারে বিনা ডাকে নিজেরাই রাস্তায় জড়ো হয়েছে। গলা উঁচিয়ে প্রতিবাদ করেছে, যা ছোট-বড় থেকে সর্বোচ্চ নেতারা ভাবতেই পারেননি।
হয়তো এর ফলস্বরূপ পরবর্তী কালে দেখা গেল, ছোট ছোট জায়গায়ও বিভিন্ন বিষয়ে শিরদাঁড়া খুঁজে পাওয়া সাধারণ মানুষরা প্রবল ভাবে নিজেদের দাবি আদায়ে নেতা থেকে স্থানীয় প্রশাসককে ‘সবক’ শেখাচ্ছে। আবার আর জি করের ঘটনার মতো গ্রামে গ্রামে চরম নির্যাতনের ঘটনায় আইনরক্ষকদের নীরব ভূমিকার প্রতিবাদে তারাও অন্যায় ভাবে আইন হাতে তুলে বাড়াবাড়ি করে ফেলছে।
তাই ওই তিন মাসের ঢেউ শাসক কিংবা বিরোধী— সবার কাছে বলে দিয়ে গেল, তোমরা নিজেদের শিরদাঁড়া খুঁজে সোজা হয়ে দাঁড়াও। না হলে শুধু রাজনীতির রং বদলের জন্য নয়, সাদা আর কালোর মধ্যে পার্থক্যটি বোঝানোর জন্য স্বাধীনতার আগের রাতটুকু ছাড়িয়ে এই প্রতিবাদগুলি স্বাধীনতার সকাল পর্যন্ত জেগে থাকবে।
সুদীপ মাইতি, কাঁথি, পূর্ব মেদিনীপুর
নবনির্মাণ
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধটি নিঃসন্দেহে প্রতিবাদীদের নতুন করে ভাবনার খোরাক সরবরাহ করেছে। শুধু তা-ই নয়, তিনি এই প্রতিবাদের গর্ভে সমাজের ‘নবনির্মাণ’ প্রত্যাশা করছেন। সেটাই তো কাম্য। না হলে ‘থোড়-বড়ি-খাড়া’ আর ‘খাড়া-বড়ি-থোড়’-এর পার্থক্য খোঁজার মতো সন্ধানী দৃষ্টি বিরল হয়ে যাবে। বর্তমান আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তা হতে দেওয়া উচিত হবে না।
জনগণের এত বড় মাপের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন ইতিপূর্বে রাজ্যবাসী দেখেনি। এক কথায় এটি অবিস্মরণীয়। আন্দোলনের ভিড় বাড়াতে ভাড়া-করা গাড়ির ব্যবস্থা করতে হয়নি। মিছিল লোক খোঁজেনি। বরং লোকে মিছিল খুঁজেছে। সংবাদে বা সমাজমাধ্যমে যে কোনও ভাবেই মিছিলের খবর পেলেই হল। এমনতর গণতান্ত্রিক আবহ সৃষ্টি এ রাজ্যের পক্ষে স্বাস্থ্যকর বইকি। যাঁরা ক্ষমতাসীন তাঁদের মনে ভয় ধরানো যাচ্ছে। রাজা উলঙ্গ কেন, এ কথা বলার সাহস জুগিয়েছে এই আন্দোলন। এটা কি কম পাওয়া?
ইতিপূর্বে যাঁরা ক্ষমতার অলিন্দে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন শ্রমিক-কৃষক দরদির মুখোশ পরে, জনগণকে পোকার মতো মনে করেছেন, তাঁরাই আবার ক্ষমতার আস্বাদন পেতে মরিয়া। তাই এই আন্দোলনে অংশীদার হয়েছেন। এঁরা কি নবনির্মাণের রাজনীতিতে আস্থা রাখেন? যাঁরা আন্দোলনের নামে কেবল মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি তুলছেন, তাঁরাই বা কোন স্বপ্নের রাজ্য গড়তে চান, তার রূপরেখা জনসমক্ষে কি পেশ করেছেন? আবার যাঁরা এমন এক ঐতিহাসিক সাড়া-জাগানো আন্দোলনের শামিল না হয়ে বরং প্রতিপক্ষ হিসাবে এর বিরুদ্ধে শুধুমাত্র কাদা মাখানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছেন, তাঁরাই বা কোন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিশা দেখাচ্ছেন?
জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্ট-সূচিত আন্দোলন এক আশার আলো দেখাচ্ছে, যা রাজনীতির নবনির্মাণের আভাস নিয়ে হাজির। তা দাবি করছে যন্ত্রের বদল, যন্ত্রীর নয়। যে নিয়মে এই ব্যবস্থা পরিচালিত তা মানুষকে অধঃপতিত করতে, মনুষ্যত্ব লাভের সমস্ত রাস্তায় কাঁটা বিছিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর। প্রবন্ধকারের সঙ্গে একমত, এই আন্দোলন যে প্রতিবাদের দৃষ্টান্ত দেখাচ্ছে, তা যেন ভোটের রাজনীতিতে হারিয়ে না যায়। বর্তমান সমাজের শ্রমজীবী মানুষের প্রয়োজনের সঙ্গে এই আন্দোলনের একাত্মতা যেন গড়ে উঠে।
তপন কুমার সামন্ত, কলকাতা-১২
শ্রমজীবীর শক্তি
‘কোথায় এসে দাঁড়ালাম’ প্রবন্ধের প্রেক্ষিতে প্রশ্ন, ক্ষমতার দুরাচারের বিরুদ্ধে এই নাগরিক আন্দোলন অনেক দিন ধরে জমে ওঠা পঙ্কিল অন্ধকার সরিয়ে নতুন আলোর সন্ধান দেবে কি? তার পর্যালোচনার ভিত্তিতে সঠিক মূল্যায়ন করে নতুন শক্তি সঞ্চয় করে, সঠিক লক্ষ্যে এই আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে পারব?
ঠিকই যে, এই আন্দোলনের প্রভাব আজ অল্প-বিস্তর পরিলক্ষিত হচ্ছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে। স্থানীয় কিংবা ঊর্ধ্বতর ক্ষেত্রে বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনাচারের বিরুদ্ধে মানুষ ক্রমাগত সরব হচ্ছেন, আন্দোলন গড়ে তুলছেন। আবাস যোজনা সংক্রান্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্রমাগত জন-বিস্ফোরণ এবং জন-জাগরণের ভিত্তিতে সংগঠিত আন্দোলন অনেকাংশে সেই সত্যকেই তুলে ধরে। যে কোনও আদর্শ গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এর প্রয়োজন অনস্বীকার্য।
ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা যখন তলানিতে, তখন এই আন্দোলন এক আশার জন্ম দিয়েছে— এই নির্ভীক পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির ডাক্তাররা সমাজের আবর্জনা দূর করে আমাদের আকাঙ্ক্ষার সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারেন। প্রতিবাদের শক্তি থেকে রাজনীতির নবনির্মাণের কাজ করতে পারেন তাঁরা। এই রাজনীতি ভয় দেখানোর সংস্কৃতিকে প্রতিহত করবে, ধর্ষণের মতো অপরাধকে প্রতিরোধ করবে, শাসকের রক্তচক্ষুকে ভয় পাবে না, চাপের মুখে নতিস্বীকার করবে না, সমস্যার গভীরে গিয়ে তার মূলোৎপাটনের চেষ্টা চালিয়ে যাবে নিরন্তর।
এই দুর্নীতিমূলক সমাজব্যবস্থার সুবিধাভোগীদের এবং তাদেরই এক সুউচ্চ অংশের স্বার্থরক্ষাকারী শাসকদের (রাষ্ট্রের) পক্ষ থেকে স্বাভাবিক কারণেই আন্দোলনকে প্রতিহত করার প্রচেষ্টা থাকবে। সেই প্রচেষ্টার ধরনও বিবিধ। এই বাস্তবতাকে বিচার করেই পরিকল্পনামাফিক এগোতে হবে সবাইকে। প্রবন্ধকার যথার্থই বলেছেন, “শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সমবেত এবং সরব হওয়াই যদি প্রতিস্পর্ধার শেষ লক্ষ্য হিসেবে গণ্য হয়, সেই লক্ষ্য পূরণ করেই যদি নাগরিক চেতনা সন্তুষ্ট ও কৃতার্থ বোধ করে, (তাতে) পোশাকের রং এবং মুখোশের ঢং বদলাতে পারে, তার বেশি প্রত্যাশা করা বাতুলতামাত্র।” এখানে ‘প্রয়োজন’-এর ধারণাটিকে নতুন করে নির্মাণের প্রয়োজন। আর এই নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে তার প্রয়োগের প্রধান সহযোগী শক্তিকে চিনতে হবে। এই শক্তি হল এ দেশের অগণিত শ্রমজীবী মানুষ।
জয়দেব চক্রবর্তী, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy