বিস্তর ঢাকঢোল পিটিয়েও লগ্নির ভাঁড়ে মা ভবানী। এ বার শিল্প পার্কের জমির দাম কমিয়ে শিল্পপতিদের মন পেতে চাইল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। মালদহের ফু়ড পার্কের জমির দাম তিন ভাগের এক ভাগ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য মন্ত্রিসভা।
রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের এক কর্তার কথায়, ‘‘এ যেন চৈত্র-বৈশাখ পেরিয়ে জ্যৈষ্ঠ সেল!’’
মঙ্গলবার বিধানসভায় মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর অর্থ তথা শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র জানান, ওই ফুড পার্কে প্রতি একর জমি কিনতে আগে দেড় কোটি টাকা লাগত। তা কমিয়ে ৪৫ লক্ষ টাকা করা হল। অমিতবাবু বলেন, ‘‘জমির দাম কমিয়ে দেওয়ায় আশা করব, অনেকেই এ বার আসবেন। মালদহ ফুড পার্কে লগ্নি পেতে সরকার নতুন করে প্রচারও করবে।’’
কিন্তু অমিতবাবুর আশা কতটা পূরণ হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে শিল্প মহলেই। কারণ, পরিকাঠামোগত অভাব কিছুই ছিল না মালদহের ফুড পার্কটিতে। জমি-জল-রাস্তা-বিদ্যুৎ সবই ছিল সেখানে খাদ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে লগ্নি টানতে বহু বার বিজ্ঞাপনও দিয়েছে রাজ্য সরকার। তার পরেও গত চার বছরে কেউ সেখানে বিনিয়োগ করতে আসেনি।
কেন? শিল্পমন্ত্রীর ব্যাখ্যা, ‘‘জমির দাম বেশি হলে প্রকল্পের খরচ বাড়ে। অনেক সময় এ জন্য ব্যাঙ্ক ঋণও মেলে না। লগ্নিকারীদের সুবিধার জন্যই সরকার জমির দাম কমিয়েছে।’’ কিন্তু শিল্পমহল বলছে, জমির দাম মোটেই লগ্নির পথে অন্যতম বাধা নয়। দেশের অন্যত্র তুলনায় বেশি দাম দিয়েই জমি কিনে শিল্প গড়া হয়। কারণ সেখানে সামগ্রিক পরিবেশটাই শিল্পবান্ধব।
বস্তুত, শিল্পপতিদের মতে, এ রাজ্যে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে তাঁদের অনীহার বড় কারণ প্রতিকূল ভাবমূর্তি। বাম আমলে জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলন লগ্নিকারীদের বিমুখ করেছিল। বাম জমানার শেষ দিকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে লগ্নি টানার মরিয়া চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তৎকালীন বিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেস। তাদের উগ্র প্রতিবাদের জেরে সিঙ্গুর থেকে বিদায় নেয় টাটাদের ছোট গাড়ির কারখানা।
তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরেও শিল্পায়ন সম্পর্কে তাদের মনোভাব পাল্টায়নি। শিল্পের জন্য এক ছটাক জমি অধিগ্রহণে এখনও মুখ্যমন্ত্রীর তীব্র অনীহা। তার উপর শাসক দলের বড়-মেজ-ছোট নেতাদের মদতে সিন্ডিকেট-রাজ, তোলাবাজির জেরে নাভিশ্বাস উঠেছে বলে অভিযোগ লগ্নিকারীদের। ফলে কোথাও জমি নিয়েও কাজ শুরু করতে বাধা পাচ্ছেন তাঁরা। কোথাও পাততাড়ি গুটিয়ে রাজ্য থেকেই চলে যাচ্ছেন। আর এ সবের বিরূপ প্রভাব পড়ছে নতুন শিল্পের সম্ভাবনায়। ফলে রাজ্য সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে ‘বেঙ্গল লিডস’ শিল্প সম্মেলন বা দিল্লি-মুম্বইয়ে শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠক করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের মন্তব্য, ‘‘নতুন শিল্প আসবে কোথা থেকে? যারা আছে, তাদেরও তো এরা তাড়িয়ে দিচ্ছে! জমির দাম কমিয়েও খদ্দের মিলবে বলে মনে হয় না।’’ বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তেলেভাজাকে শিল্প মনে করেন, সেখানে লগ্নি করবে কোন শিল্পপতি?’’
সমস্যা রয়েছে শিল্প পার্ক ঘিরেও। নিজের জমি নীতির পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী প্রায়ই বলেন, জমি কোনও সমস্যা নয়। সরকারের হাতে কয়েক হাজার একর জমি রয়েছে। শিল্পপতিরা চাইলেই সেখানে শিল্প করতে পারেন। কিন্তু সরকারের হাতে থাকা জমি ভারী শিল্প করার উপযুক্ত কি না, সেটাই প্রশ্ন। শিল্পোন্নয়ন নিগম সূত্রের খবর, তাদের ২২টি শিল্পতালুক রয়েছে। তার মধ্যে ১৪টি তালুকে ২৮৬১ একর জমি ফাঁকা পড়ে রয়েছে। কিন্তু তিনটি ছাড়া কোনও তালুকেই বড় শিল্প স্থাপনের মতো জমির সংস্থান নেই বলে জানাচ্ছেন নিগমেরই এক কর্তা।
প্রশাসন সূত্রের খবর, হাওড়ার অঙ্কুরহাটিতে জেমস-জুয়েলারি পার্ক ছাড়া শিল্পোন্নয়ন নিগম গত চার বছরে আর কোনও শিল্পতালুক তৈরি করতে পারেনি। কোথাও কোথাও বাম জমানায় তৈরি হওয়া শিল্পতালুকের সম্প্রসারণ করা হয়েছে মাত্র। ওই সব তালুকে শিল্প গড়ার আহ্বান জানিয়ে বার কয়েক বিজ্ঞাপন দেওয়া হলেও লগ্নি আসেনি। তাই মালদহের ফুড পার্কে বিনিয়োগ না-আসাটা ব্যতিক্রম হিসাবে দেখছেন না শিল্প দফতরের কর্তারা। এর মধ্যে বোলপুরের তালুকে শিল্প না-আসায় সেখানে আবাসন গড়ার কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
অমিতবাবু অবশ্য এ সব তথ্য শুনতে নারাজ। তাঁর দাবি, ‘‘এ দিনই পাঁচটি শিল্পতালুকে ১৪টি সংস্থাকে প্রায় ৯৮ একর জমি দিয়েছে শিল্পোন্নয়ন নিগম। এতে ১০০৪ কোটি টাকা বিনিয়োগে সরাসরি ১৫৩৯ জনের কর্মসংস্থান হবে।’’
অর্থমন্ত্রীর আরও দাবি, চিন-জাপানের লগ্নিকারীরাও রাজ্যের শিল্পতালুকে লগ্নি করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। আর বোলপুরের শিল্পতালুক গুটিয়ে আবাসন গড়ার ঘোষণা প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য, ‘‘আবাসনও শিল্প। এতেও বিনিয়োগ হয়। কর্মসংস্থান হয়!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy