তিন মূর্তি। মধ্যমণি অনুব্রত মণ্ডল। বাঁয়ে সুদীপ্ত ঘোষ, ডাইনে মনিরুল ইসলাম। ফাইল চিত্র
মাথায় টান পড়েছে আগেই। এ বার সঙ্গে জুড়ল কানও।
বীরভূমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের ঘাড়ে পাড়ুই নিয়ে সিবিআই তদন্তের খাঁড়া আপাতত আটকে আছে ডিভিশন বেঞ্চে। এর মধ্যেই খারিজ হয়ে গেল তাঁরই দক্ষিণ হস্ত হিসেবে পরিচিত সুদীপ্ত ঘোষের আগাম জামিনের আর্জি। পুলিশ পিটিয়েও স্রেফ অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ হওয়ায় এত দিন বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সুদীপ্ত। এমনকী, এ দিন সরকারি কৌঁসুলি পর্যন্ত তাঁর আগাম জামিনের আর্জিতে আপত্তি জানাননি! কিন্তু পুলিশ তাঁকে ধরতে না পারলেও কেস ডায়েরিতে কোনও ফাঁক রাখেনি। যা দেখে সিউড়ি জেলা আদালতের (ভ্যাকেশন কোর্ট) অতিরিক্ত জেলা দায়রা বিচারক শুভাশিস ঘোষাল জানিয়ে দিলেন, এতে যা তথ্য আছে, তাতে আগাম জামিন দেওয়া যায় না!
গত পঞ্চায়েত ভোটের আগে পুলিশ ও প্রশাসনের উপরে ‘বোম মারার’ হুমকি দিয়েছিলেন অনুব্রত। তার কিছু দিনের মধ্যেই পাড়ুইয়ে সাগর ঘোষের বাড়িতে হামলা। সেই হামলায় সাগরবাবুর মৃত্যু হয়। প্রকাশ্য সভায় দাঁড়িয়ে যে পুলিশকে আক্রমণের কথা বলেছিলেন অনুব্রত, ঘটনার তদন্তে নেমে প্রথম থেকে সেই পুলিশই ইচ্ছাকৃত ভাবে সঠিক পথে হাঁটছিল না বলে অভিযোগ। সম্প্রতি হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ রায় দেওয়ার সময়েও পুলিশের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করে। বিচারপতি হরিশ টন্ডন তীব্র ভর্ৎসনা করেন রাজ্য পুলিশের ডিজি-র। পুলিশমহলের অনেকেই বলছেন, একই ঘটনা ঘটছে অনুব্রতর দুই সহযোগী সুদীপ্ত ঘোষ এবং মনিরুল ইসলামের ক্ষেত্রেও। লাভপুর হত্যা মামলায় মনিরুল ইসলামের দিকেই মূল অভিযোগের আঙুল। অথচ পুলিশ তাঁকে ধরতে পারেনি এখনও। সুদীপ্তর বেলাতেও একই ছবি। এমনকী, সম্প্রতি এই ব্যাপারে অনুব্রত নিজেই বলেছেন, “সুদীপ্ত জেলাতেই আছে, পুলিশ পারলে ওকে ধরুক।”
জেলা সভাপতির ছত্রচ্ছায়ায় থাকা সত্ত্বেও সুদীপ্ত আগাম জামিন নিয়ে নিজেকে সুরক্ষিত করতে চাইছিলেন। কিন্তু তাতে শেষ পর্যন্ত বাদ সাধল পুলিশই। গত ৩ সেপ্টেম্বর বোলপুর থানায় ঢুকে ভাঙচুর এবং পুলিশ পেটানোর অভিযোগ রয়েছে সুদীপ্তর বিরুদ্ধে। সেই ঘটনার পরপরই বীরভূমের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া বলেছিলেন, “পুলিশ কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।” এর পরেও তিনি মুখে কুলুপ আঁটেন। কিন্তু তৃণমূল নেতাদের দাপটে পুলিশের নিচুমহলে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সেটা এসপি-র কথা থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ দিন বিচারকের রায়ের পরে অলোক ফোন ধরেননি। এসএমএসেরও জবাব দেননি। অন্য পুলিশ কর্তারাও চুপ। কিন্তু নিচুতলার পুলিশ খুশি। তাঁদের বক্তব্য, “শাসক দলের চাপে সুদীপ্তকে ধরতে পারিনি। কিন্তু কোর্টে ধাক্কা খেতে হল তাঁকে।”
এ দিন সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেননি অনুব্রত। সুদীপ্তবাবুর সঙ্গে এ দিন যোগাযোগ করা যায়নি। বোলপুরে তৃণমূলের কার্যালয়ে তিনি যাননি, হরগৌরীতলায় তাঁর বাড়িতে গেলে বলে দেওয়া হয়, সুদীপ্ত নেই। মোবাইলে ফোন করলে ধরেননি।
আইন-আদালতের ফাঁসে এখন কঠিন সময় তৃণমূলের। হাইকোর্টের নির্দেশে সাংসদ তাপস পালের বিরুদ্ধে নাকাশিপাড়া থানায় এফআইআর করতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ। সারদা-কাণ্ডে উঠে আসছে একের পর এক তৃণমূল নেতার নাম। সিবিআই-ইডি’র সাঁড়াশি চাপে শাসকদল।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু এ রাজ্যেই নয়, জাতীয় রাজনীতির বেশ কিছু ঘটনায় স্পষ্ট হচ্ছে, যতই দাপুটে হ’ন, প্রশাসনিক ক্ষমতার জোরে আর আইন লঙ্ঘন করতে পারছেন না অনেক তাবড় নেতা। লালু প্রসাদ, জয়ললিতা, এ রাজা থেকে ওমপ্রকাশ চৌটালা আইনভঙ্গের ফল ভুগতে হচ্ছে সকলকেই। তাই তাপস পালের বিরুদ্ধে এফআইআর করার নির্দেশ বা সুদীপ্ত ঘোষের আগাম জামিনের আবেদন খারিজের ঘটনা আর অপ্রত্যাশিত নয়।
শুনানির শুরুতে সুদীপ্তদেরপক্ষের আইনজীবী তথা তৃণমূল নেতা মলয় মুখোপাধ্যায় আদালতের কাছে দাবি করেন, এলাকায় অবৈধ মদের ভাটি কেন ভাঙা হচ্ছে না, কেন পুলিশ অভিযুক্তদের ধরছে না সে ব্যাপারে স্মারকলিপি দিতেই সুদীপ্তরা ৩ সেপ্টেম্বর রাতে বোলপুর থানায় যান। সেখানে পুলিশের সঙ্গে বাদানুবাদ হয়েছিল মাত্র। আর কিছু ঘটেনি। মলয়বাবু বিচারককে বলেন, “আমার মক্কেলরা এলাকার লোক, সরকারি কর্মী। তদন্তে সাহায্য করবেন। ওঁদের জামিন দেওয়া হোক।” মজার বিষয় হল, সরকারি আইনজীবী রণজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (যিনি বাম আমলে তৃণমূলের হয়ে নানুরের সুচপুর গণহত্যার মামলা লড়েছিলেন) অভিযুক্তদের আইনজীবীর বিরোধিতা না করে উল্টে বরং কার্যত জামিনের হয়েই সওয়াল করেন! তিনি বলেন, “অবৈধ মদের ভাটি ভাঙচুর নিয়ে ডেপুটেশন দিতেই ওঁরা থানায় যান। পুলিশের সঙ্গে তর্কাতর্কি হয়েছে। তার বেশি কিছু হয়নি। ওঁদের জামিন দেওয়া হলে আমার কোনও আপত্তি নেই।” দেখা যায়, দুই আইনজীবী দু’দিকে দাঁড়ালেও কথার সুর দু’জনের একই! এই ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। এর আগে লোকসভা ভোটের সময় বুথে ঢুকে ভোটকর্মীদের মারধর ও ছাপ্পা দেওয়ায় অভিযুক্ত সোনামুখীর তৃণমূল বিধায়ক দীপালি সাহার হয়ে সওয়াল করেছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। সে দিনও সরকারি উকিল জামিনের বিরোধিতা করেননি। জামিন পান দীপালিদেবী।
এর পরেও পুলিশের জমা দেওয়া কেস ডায়েরি পড়ে বিচারক বলেন, “এতে যা তথ্য রয়েছে, তাতে আমি অভিযুক্তদের আগাম জামিন মঞ্জুর করছি না।” ফলে এ বার বোলপুর পুরসভার কর্মী, তৃণমূলের যুব নেতা সুদীপ্ত ঘোষের জন্যই ‘কঠিন সময়’ আসছে, বলছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy