সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারে ‘পাঠযোগ্য’ সংবাদপত্রের তালিকা বেঁধে দিয়ে আদেশনামা জারি করেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। রাজ্য-রাজনীতিতে তোলপাড় ফেলা সেই বিজ্ঞপ্তি এ বার ধরা পড়ল সিবিআইয়ের নজর-জালে। সারদা-সহ বিবিধ অর্থলগ্নি সংস্থার অবৈধ কারবার সম্পর্কিত তদন্তের সূত্রে।
পাঠকদের মধ্যে ‘মুক্ত চিন্তার প্রসার’ ঘটানোর লক্ষ্যে প্রায় তিন বছর আগে মমতা সরকার ফরমান দেয়, ‘রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত’ আটটি সংবাদপত্রই শুধু সরকার অনুমোদিত গ্রন্থাগারে রাখা যাবে, তার বাইরে নয়। সে সংক্রান্ত যে বিজ্ঞপ্তি রাজ্য তখন জারি করে, সারদা-তদন্তকারী সিবিআই এখন তার প্রেক্ষাপট যাচাই করতে চাইছে। সংশ্লিষ্ট ফাইলে সরকারের বিভিন্ন আধিকারিক কী ‘নোট’ দিয়েছিলেন, মূলত তা জানতে চেয়ে বৃহস্পতিবার রাজ্য জনশিক্ষা প্রসার দফতরকে তারা চিঠি দিয়েছে।
এবং কেন এই চিঠি, কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর সূত্রে তার কারণও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সূত্রটির দাবি: সরকারের অনুগত ও সমর্থক ওই আটটি সংবাদপত্রের কয়েকটি সারদা-রোজভ্যালি-আইকোরের মতো অবৈধ বা বিতর্কিত লগ্নিসংস্থার টাকায় চলত বলে জানা গিয়েছে। সরকারি পছন্দ-তালিকায় তাদের নাম থাকায় প্রশ্ন উঠেছে, কাগজগুলির পরিচালনায় রাজ্য সরকারের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কোনও ভূমিকা ছিল কিনা, আর থাকলে তার মাত্রা কতটা। “এর বিস্তারিত তথ্য হাতে পেতেই সংশ্লিষ্ট দফতরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।” বলছেন এক সিবিআই-কর্তা।
সিবিআইয়ের দুই অফিসার বৃহস্পতিবার সল্টলেকের বিকাশ ভবনে জনশিক্ষা দফতরে গিয়ে চিঠিটি দিয়ে এসেছেন। তাতে কিছু প্রশ্নের জবাব চাওয়া হয়েছে। যেমন, সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারে নির্দিষ্ট সংবাদপত্র রাখার নির্দেশিকাটি কার কথায় জারি করা হয়েছিল, ফাইলে কার কার সই রয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। সিবিআই-সূত্রের খবর, ইতিমধ্যে তারা বিজ্ঞপ্তির প্রতিলিপি সংগ্রহ করেছে। তারই ভিত্তিতেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
এ দিকে তিন বছর বাদে খোদ সারদা-তদন্তকারী কেন্দ্রীয় সংস্থার কাছ থেকে আচমকা এমন চিঠি পেয়ে নবান্নে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। রাজ্য প্রশাসনিক সদরের অন্দরের খবর: চিঠি আসতেই জনশিক্ষা প্রসার দফতরের ভারপ্রাপ্ত সচিব বিবেক কুমার ফোন করেন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রকে। বিস্তারিত আলোচনা করতে বিবেককে নবান্নে ডেকে পাঠান মুখ্যসচিব। দু’জনে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন। সিবিআই-মোকাবিলায় সরকারের ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ কী হতে পারে, তা নিয়ে সবিস্তার মত বিনিময় হয়। এ-ও স্থির হয়, মুখ্যমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে সিবিআই-কে চিঠির জবাব দেওয়া হবে।
কিন্তু ঘটনা হল, সিবিআইয়ের চিঠি পেয়ে ফাইলের খোঁজে নেমেছিলেন দফতরের যে অফিসারেরা, তারা বেকুব বনে গিয়েছেন। কারণ, ফাইল বেপাত্তা! “ওটা খুঁজে বার করতে আমরা যাবতীয় চেষ্টা চালিয়েছি। পাইনি।” জানাচ্ছেন দফতরের এক শীর্ষ কর্তা। যদিও তাঁর দাবি, এতে কোনও সমস্যা হবে না। ওঁঁর কথায়, “নির্দেশিকার বিরুদ্ধে কোর্টে একটা মামলা চলছে। তাই ফাইলের সব কাগজ-পত্র ফোটোকপি করা রয়েছে। সেগুলোই কপি করে অ্যাটেস্ট করিয়ে সিবিআই-কে পাঠানো হবে।”
এ সব করার আগে দফতরের মন্ত্রীর অনুমতি নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ওই শীর্ষ আধিকারিক। জনশিক্ষা প্রসার দফতরের মন্ত্রী আব্দুল করিম চৌধুরী কিংবা ভারপ্রাপ্ত সচিব বিবেক কুমার সিবিআইয়ের চিঠি প্রসঙ্গে শুক্রবার অবশ্য কারও মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তাঁরা ফোন ধরেননি, এসএমএসের জবাব আসেনি।
বিতর্কিত আদেশনামাটিতে ঠিক কী বলা হয়েছিল?
দিনটা ছিল ২০১২-র ১৪ মার্চ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতায় এসেছে তখন এক বছরও হয়নি। সে দিন জনশিক্ষা প্রসার দফতরের বিশেষ সচিবের স্বাক্ষরিত নির্দেশিকাটিতে পাঁচটি বাংলা, একটি হিন্দি ও দু’টি উর্দু সংবাদপত্রের নাম উল্লেখ করে জানিয়ে
দেওয়া হয়, এর বাইরে কোনও সংবাদপত্র সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারে কেনা যাবে না। যার অর্থ, সেখানকার পাঠকেরা শুধু ওই ক’টি কাগজই পড়ার সুযোগ পাবেন। ইংরেজি খবরের কাগজ দূরস্থান,
বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিকও তাঁরা পাবেন না।
উল্লেখ্য, বাম আমলে রাজ্যের সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রায় আড়াই হাজার গ্রন্থাগারে অন্যান্য সংবাদপত্রের সঙ্গে সিপিএমের দৈনিক মুখপত্র রাখা কার্যত বাধ্যতামূলক ছিল। তবে এ ব্যাপারে লিখিত কোনও নির্দেশনামা দেওয়া হয়নি। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানার বছর না-ঘুরতেই লিখিত ভাবে এ হেন নির্দেশ জারি হওয়ায় প্রশাসনের ভিতরে-বাইরে সমালোচনার ঝড় ওঠে। কারণ, বাছাই-তালিকার কাগজগুলোর প্রায় সব ক’টাই ছিল শাসকদল তথা সরকারের অনুগত ও সমর্থক হিসেবে পরিচিত।
এই পরিস্থিতিতে দু’সপ্তাহ বাদে একটি ইংরেজি দৈনিক-সহ আরও পাঁচটি সংবাদপত্রকে তালিকায় যুক্ত করে সরকার। তার পরে তিন বছর পেরিয়ে গিয়েছে। নির্দেশিকা এখনও বহাল। এ নিয়ে মামলাও চলছে। সিবিআইয়ের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ পুরো ঘটনায় নিঃসন্দেহে বাড়তি মাত্রা জুড়েছে। কেন্দ্রীয় এক তদন্তকারীর বক্তব্য, “কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হল, সেটা আমাদের বিবেচ্য নয়। কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাবলিক লাইব্রেরিতে বিতর্কিত লগ্নিসংস্থার টাকায় চলা খবরের কাগজ রাখার নির্দেশ রাজ্য কেন দিল, সেটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।”
প্রসঙ্গত, সরকারি তালিকার বাংলা দৈনিক ‘সকালবেলা’ ও হিন্দি ‘আজাদ হিন্দ’-এর মালিক ছিল সারদা গোষ্ঠী। ‘খবর ৩৬৫ দিন’ চালায় রোজভ্যালি সংস্থা, যার মালিক গৌতম কুণ্ডুকে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ইতিমধ্যে অভিযুক্ত আইকোর গ্রুপের হাতে তখন ‘একদিন’ পত্রিকার মালিকানা। তালিকায় পরে সংযোজিত বাংলা দৈনিক ‘কলম’-এও সারদার টাকা ঢুকেছে বলে তদন্তকারীদের দাবি। তাঁদের একাংশের এ-ও ধারণা, আর্থিক সম্পর্কের গণ্ডি ছাড়িয়ে সারদা-রোজভ্যালির সঙ্গে কাগজগুলির রাজনৈতিক সংশ্রব গড়ে উঠেছিল। দেখা যাচ্ছে, তালিকায় থাকা ‘সংবাদ প্রতিদিন’ পত্রিকার সম্পাদক ও সহযোগী সম্পাদক দু’জনেই তৃণমূলের রাজ্যসভার সদস্য, এবং সারদা-মামলায় দু’জনেই এখন জেলে। সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন গ্রেফতার হওয়ার পরে ‘সকালবেলা’ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। হিন্দি দৈনিক ‘সন্মার্গ’ ও উর্দু দৈনিক ‘আখবর-ই-মশরিক’-এর সম্পাদকেরাও শাসকদলের রাজ্যসভা সদস্য। এমনকী, ‘কলম’-এর সম্পাদকও রাজ্যসভার তৃণমূল এমপি।
এমতাবস্থায় বিতর্কিত অর্থলগ্নি সংস্থা, রাজ্য সরকার ও কয়েকটি সংবাদপত্রের মধ্যে কোনও যোগসূত্র থাকলেও থাকতে পারে বলে সিবিআই মনে করছে। “আমরা সম্ভাব্য সূত্রটির খোঁজ করছি।” মন্তব্য করেছেন ব্যুরোর এক কর্তা। তিনি বলেন, “আমরা খতিয়ে দেখতে চাই, সারদা-রোজভ্যালির মতো কোম্পানির কাগজ লাইব্রেরিতে রাখা বাধ্যতামূলক করা হল ঠিক কার নির্দেশে। কাউকে কিছু পাইয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য এখানে কাজ করেছে কি না, তা-ও যাচাই করা দরকার।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy