পাশ-ফেল নিয়ে কেন্দ্রের খসড়া নিয়ে শুরু হল নতুন বিতর্ক। নয়া শিক্ষা নীতির খসড়ায় উচ্চ-প্রাথমিকে পাশ-ফেল ব্যবস্থা ফেরানোর পক্ষেই প্রস্তাব দিয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। টিএসআর সুব্রহ্মণ্যমের নেতৃত্বে গড়া কমিটি সম্প্রতি নয়া শিক্ষা নীতির খসড়া প্রস্তাবে জানিয়েছে, চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্তই থাকতে চলেছে পরীক্ষা ব্যবস্থাহীন পঠনপাঠন। কিন্তু নতুন ক্লাসে উঠতে গেলে পঞ্চম শ্রেণি থেকেই বসতে হবে পরীক্ষায়। এখন প্রতি ক্লাসে পরীক্ষা হলেও সবাইকেই পরের ক্লাসে তুলে দেওয়া হয়।
কিন্তু শিক্ষাবিদদের একাংশ জানাচ্ছেন, নয়া শিক্ষা নীতির খসড়া প্রস্তাবটি কেন্দ্রীয় সরকারের তৈরি করা ২০০৯ সালের শিক্ষার অধিকার আইনের পরিপন্থী। ওই আইন মোতাবেক অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কোনও পড়ুয়াকে ফেল করানো যাবে না। সে ক্ষেত্রে এই নয়া শিক্ষানীতি প্রয়োগের আগে প্রথমেই এই আইনের সংশোধনী আনা প্রয়োজন। এই রাজ্যে বাম সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। ১৯৮১ সালে কার্যকর হয় এই সংক্রান্ত বিধি। বিতর্কের শুরু সেই থেকেই। এই নয়া ব্যবস্থা আদতে শিক্ষা ব্যবস্থার ভিতকেই দুর্বল করে দিচ্ছে বলে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকেন শিক্ষাবিদেরা।
সেই সময়ে তত্কালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ দে-র যুক্তি ছিল, প্রারম্ভিক শিক্ষায় কাউকে জোর করে আটকে রাখাটা অযৌক্তিক। সব পড়ুয়াই সব বিষয়ে সমান দক্ষ হতে পারে না। ২০০৯ সালে শিক্ষার অধিকার আইনে বলা হয়, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কোনও পড়ুয়াকেই ফেল করানো যাবে না। সেই মতো দেশের বাকি সব রাজ্যের সঙ্গে এ রাজ্যেও শিশু শিক্ষা আইন অনুযায়ী অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল ব্যবস্থা উঠে যায়। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পরে শাসকদল তৃণমূল পাশফেল ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার পক্ষে সওয়াল শুরু করে। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা চান অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ ফেল প্রথা তুলে দেওয়ার নিয়ম উঠে যাক। পার্থবাবু নয়া শিক্ষা নীতির খসড়া প্রস্তাব সম্পর্কে বলেন, ‘‘আমরা তো পাশফেল প্রথা নিয়ে আমাদের নীতি আগেই পরিষ্কার করে জানিয়েছি। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে এখনও এ নিয়ে কোনও চিঠিপত্র পাইনি। পেলে মুখ্যমন্ত্রী ও সচিবদের সঙ্গে আলোচনায় বসব।’’
যদিও নয়া এই খসড়া-প্রস্তাব নিয়ে শিক্ষাবিদেরা দ্বিধাবিভক্ত। শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার নয়া নীতির সমর্থক। তিনি বলেন, ‘‘যখন স্কুলে বাচ্চাদের টেনে আনাটাই মূল লক্ষ্য ছিল, তখন এই পাশ-ফেল ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়তো প্রাসঙ্গিক ছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার উত্কর্ষের প্রশ্নে এই নীতি খুবই প্রয়োজন।’’ হেয়ার স্কুলের প্রধানশিক্ষক সুনীল দাস খসড়া প্রস্তাবেরই সমর্থক। তাঁর বক্তব্য, ‘‘পাশ-ফেলের চাপ না থাকায় পড়ুয়ারা ঢিলেমি দিয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে। পাশফেল ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনলে আখেরে পড়ুয়াদেরই লাভ হবে।’’ বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল স্কুলের প্রধানশিক্ষিকা স্বপ্না সিংহও এই নতুন নীতিই সমর্থন করছেন। রাজ্য সরকারি স্কুল শিক্ষক সমিতির প্রাক্তন সভাপতি দীপক দাসের মতে বুনিয়াদি স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা শিশুবান্ধব হওয়া প্রয়োজন। তাই প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পাশফেল না থাকায় পড়াশোনাটা অনেক সহজ হয়ে ধরা দেবে একটি শিশুর কাছে। কিন্তু একটা সময়ের পর তাতে লাগাম প্রয়োজন। দীপকবাবুও বললেন, ‘‘অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশফেল না থাকায় শিক্ষা ব্যবস্থাই অনেকটা গুরুত্ব হারিয়েছে। পড়ুয়া-অভিভাবক সকলেই পড়াশোনার বিষয়টিকে হাল্কা ভাবে নিতে শুরু করায় সাধারণ পড়ুয়াদের মান কমেছে।’’
অল বেঙ্গল টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এবিটিএ) সাধারণ সম্পাদক কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য অবশ্য পাশ-ফেলের বর্তমান ব্যবস্থা রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। ‘‘স্কুলছুট কমাতে হাতিয়ার ছিল পাশ-ফেলহীন শিক্ষা। পড়ুয়াদের ফেল করা মানে তা শিক্ষকদের ব্যর্থতা’’, বললেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy