Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

‘হুল্লোড়’-এ প্রকাশ হচ্ছে গোপন কথা

দেরি না করে ওই হোম সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেন কর্তারা। জানতে পারেন, ওই হোমেই কয়েক বছর আগে এক আবাসিককে নিরাপত্তাকর্মী ধর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। অভিযুক্ত ধরাও পড়েছিল।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৭ ০৯:২০
Share: Save:

রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের হোম থেকে পাঠানো ছেলেমেয়েদের গল্প-কবিতা বাছতে গিয়ে শিশু অধিকার ও সুরক্ষা আয়োগের কর্তাদের চোখ আটকে গিয়েছিল লেখাটার উপরে।

নদিয়ার কৃষ্ণনগরের মেয়েদের হোমের এক আবাসিক, ক্লাস এইটের পাপিয়া দাসের লেখা। সাদা খাতার ছেঁড়া পাতায় কালো কালিতে গোটা গোটা হরফে ‘এক ইতিহাসের কথা’ নাম দিয়ে গল্প লিখেছে সে। তার বিষয়বস্তু চমকে দিয়েছিল কর্তাদের— ‘এক সাহেব ভাগীরথীর তীরে আশ্রম খুলেছিলেন। সেখানে অসহায় মেয়েরা থাকত। হঠাৎ সাহেব মারা যেতে সব শেষ হয়ে গেল। এখানে মেয়েরা যা হাতের কাজ করত সব বন্ধ। তারা টাকা পায় না। মেয়েদের জন্য সরকার থেকে টাকা আসছে। কিন্তু তারা ভাল নেই। তাদের ভাল করে খেতে দিচ্ছে না। আশা ভেঙে আজ নিরাশা তৈরি হয়েছে। তারা বাঁচাও বাঁচাও বলে সরকারকে ডাকছে।’

এটা গল্প, নাকি গল্প লিখতে গিয়ে কলমে উঠে আসা বাস্তব অভিজ্ঞতার ইতিবৃত্ত? দেরি না করে ওই হোম সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেন কর্তারা। জানতে পারেন, ওই হোমেই কয়েক বছর আগে এক আবাসিককে নিরাপত্তাকর্মী ধর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। অভিযুক্ত ধরাও পড়েছিল।

তার পরেও কি তা হলে হোমে সব কিছু ঠিকঠাক চলছে না? তা দেখতে গত জুলাই মাসেই ওই হোম পরিদর্শনে যান কর্তারা। কথা বলেন আবাসিক মেয়েদের সঙ্গে। শিশু আয়োগ সূত্রের খবর, সেখানে খোঁজ মেলে বেশ কিছু অনিয়মের। বছর চোদ্দোর কিশোরীর কলমে উঠে আসা গল্প যে নিছক গল্প ছিল না, সেটাও প্রতিষ্ঠিত হয়।

এই ভাবে সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত ছোটদের হোমের অনেক অজানা অনিয়ম, আড়ালে থেকে যাওয়া যন্ত্রণা এবং না-বলা কথা যাতে আবাসিকদের লেখার মাধ্যমে সামনে আসে, সেই উদ্দেশ্যেই ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছে শিশু আয়োগ। ‘হুল্লোড়’ নামে সেই পত্রিকার মার্চ আর জুন সংখ্যা ইতিমধ্যে প্রকাশিত। এটি বণ্টন করা হচ্ছে সমস্ত সরকারি জায়গায়, যাতে মন্ত্রী-আমলা সকলের চোখের সামনে বিষয়গুলি আসে।

আয়োগের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তী এই পত্রিকাকে ‘এত দিন নথিভুক্ত না-হওয়া ইতিহাসের দলিল’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। জানিয়েছেন, কলকাতায় এবং প্রতিটি জেলায় এমন কিছু কর্মী নিয়োগ করা হয়েছে, যাঁরা বিভিন্ন হোমে গিয়ে ছেলেমেয়েদের লেখা সংগ্রহ করে আনছেন। আবাসিকেরা কে কী লিখছে, তা হোমের সুপার বা অন্য কোনও কর্মীকে দেখতে দেওয়া হচ্ছে না। পাছে হোমের কোনও দুর্নীতি বা শিশু-কিশোরদের কোনও মানসিক-শারীরিক সমস্যার কথা জানাজানি হবে বুঝতে পেরে হোম কর্তৃপক্ষ তা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। প্রয়োজন পড়লে মৌখিক ভাবে আবাসিকদের বক্তব্য সংগ্রহ করে এনে তা গল্পের আকারে ছাপা হচ্ছে।

কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, যদি এক বার কোনও কিশোর বা কিশোরী হোমের কোনও অনিয়ম বা নিজের কোনও সমস্যার কথা লেখার মাধ্যমে জানায়, তা হলে পরবর্তীকালে তাকে হোম কর্তৃপক্ষের কোপে পড়তে হবে না তো? অনন্যাদেবী বলেন, ‘‘আমাদের কর্মীরা নিয়মিত হোম পরিদর্শনে গিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে একান্তে কথা বলছেন। ফলে, তেমন কিছু হলে জানতে পারব। আর কৃষ্ণনগরের মতো যে সব হোম থেকে গুরুতর অভিযোগ মিলছে, সেখানে আলাদা করে জেলা শিশু নিরাপত্তা অফিসারেরা নজরদারি রাখছেন।’’

শিশু আয়োগের মতে, গল্প বা কবিতার মোড়কে খোলাখুলি নিজের মানসিক আঘাত, ক্ষোভ বা শারীরিক নির্যাতনের কথা প্রকাশ করতে পারা, নিজের ভুল-অন্যায় স্বীকার করতে পারাটাও কিশোর-কিশোরীদের ক্ষেত্রে অনেকটা কাউন্সেলিংয়ের কাজ করছে। সেই সঙ্গে ডানা মেলছে সৃজনশীলতা। ‘হুল্লোড়’ তাই থামবে না।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE