মৃতা অপর্ণা বাগের জমিতে আজও মোছেনি ট্রাক্টরের ক্ষতচিহ্ন। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
হলুদ ফুল নিয়ে সর্ষে গাছের নরম ডগাগুলো হাওয়ায় দুলছিল। মাঝে খানিকটা ফাঁকা জায়গা ক্ষতচিহ্নের মতো। কৃষ্ণগঞ্জের ঘুঘড়াগাছি গ্রামের ২২ বিঘা মাঠে ওই ফাঁকা খাপছাড়া অংশটুকুই যাবতীয় আশঙ্কা আর আতঙ্কের কেন্দ্রবিন্দু। গত ২৩ নভেম্বর সকালে ওইখানেই ট্রাক্টর চালিয়ে খেতের ফসল তছনছ করে দিচ্ছিল জমি মাফিয়ারা। যা রুখতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন গ্রামের বধূ অপর্ণা বাগ। নির্মম এই হত্যালীলার পর মাস পেরিয়েছে। এখনও অভিযুক্তদের অনেকে অধরা। ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা নিরীহ গ্রামবাসীরা তাই একান্ত প্রয়োজন না পড়লে যাচ্ছেন না জমির কাজে। শীতের সকালে মাঠের প্রান্তে দু’একজন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কাজ করলেও আগন্তুক দেখলেই চকিতে সরে যাচ্ছেন আড়ালে।
নিহত অপর্ণা বাগের পরিবার সেদিনের পর আর মাঠমুখো হয়নি। শোকে-দুঃখে-ভয়ে এখনও ঘরবন্দি তিন ছেলে-মেয়ে। হাঁড়িতে টান পড়ায় রবিবার সকালে ভ্যান নিয়ে বেরিয়েছেন অপর্ণাদেবীর স্বামী দেবানন্দবাবু। তাতেও যেন স্বস্তি নেই ছেলেমেয়েদেরকখন ফিরবে বাবা। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী বড় মেয়ে নীলিমা সংসারের হাল ধরেছে। মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে অপর্ণাদেবীর ছেলে দীপঙ্কর। কিন্তু পড়ায় মন বসে না কিছুতেই। দীপঙ্কর বলে, ‘‘আগে পড়তে বসতে দেরি হলে বকাঝকা করত মা। এখন আর কেউ কিছু বলার নেই। সেটাই সব চাইতে কষ্ট দেয়। জানি না পরীক্ষার কি হবে।’’ মেয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে সেই যে জামাইবাড়ি এসেছিলেন, আর ফেরা হয়নি সুরবালা ধারার। রান্নাবান্না, ঘরের কাজ সামলে মাঝে-মধ্যেই ভাবেন জমিতে যাবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়ে ওঠে না। তিনি বলেন, ‘‘অনেক কষ্ট করে মেয়েটা জমিতে সর্ষে চাষ করেছিল। সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবু কিছুতেই ওদিকে যেতে পারি না। ওর পাশেই যে দেহটা পড়ে ছিল। নাতি নাতনিদেরও মাঠে পাঠাতে পারি না। ভয় লাগে, ওরা যদি আবার হামলা করে।’’
সেদিনের গুলিচালনার ঘটনায় নাম জড়িয়েছিল তৃণমূল ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত একাধিক সমাজবিরোধীর। তাদের মধ্যে লঙ্কা ঘোষ ও পলাশ ঘোষকেই কেবল পুলিশ গ্রেফতার করতে পেরেছে। বাকি অভিযুক্তরা এখনও অধরা। পুলিশ এখনও পর্যন্ত আহতদের জবানবন্দি দেওয়ার ব্যবস্থা করেনি। সব মিলিয়ে পুলিশের উপরে ধীরে-ধীরে ভরসা হারাতে শুরু করেছেন গ্রামের মানুষ। তাই পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তা নিয়ে শনিবার রাতে তাঁরা বৈঠকে বসেছিলেন। মঙ্গলবার ফের আলোচনায় বসার কথা। স্থানীয় বাসিন্দা গোপেশ্বর মাঝি বলেন, ‘‘গ্রামবাসীরা এখনও এককাট্টা আছি। যতদিন না অপরাধীরা শাস্তি পাচ্ছেন ততদিন আমরা এক সঙ্গে মিলে লড়াই চালিয়ে যাব।’’
গাঁয়ের লোকেরাই আজও দায়িত্ব নিয়ে ভিজিয়ে দেন অপর্ণাদেবীর হাতে তৈরি সর্ষে খেত। যত্নে-অযত্নে বেড়ে ওঠা সর্ষে গাছ এখন প্রায় কোমর সমান লম্বা। তবে, শারীরিক ও মানসিক ভাবে গ্রামবাসীরা হতাহতদের পাশে থাকলেও আর্থিক সাহায্য করার মতো জায়গায় নেই কেউ। সেদিনের ঘটনায় জখম দুই মহিলা ও এক কিশোরের চিকিত্সায় তাই নাভিশ্বাস উঠেছে পরিবারের। চার দিন আগে কলকাতায় সরকারি হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন শ্যামলী তরফদার। গুলিতে তাঁর চোয়াল ভেঙে গিয়েছিল। চিকিত্সায় প্রচুর খরচ। সিপিএমের তরফে ২৫ হাজার টাকা মিলেছিল। সাহায্য বলতে ওইটুকুই। এই অবস্থায় মাসে চার টাকা হারে সুদে ধার করেছেন শ্যামলীদেবীর স্বামী দিনমজুর উত্তম তরফদার। স্ত্রী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও ধারের টাকা কী করে শোধ দেবেন তার চিন্তাতেই পাগল হওয়ার জোগাড়। শ্যামলীদেবী বলেন, ‘‘আমি তো বেঁচে বাড়ি ফিরলাম। কিন্তু দেনার দায়ে এবার আমার স্বামীর মরে যাওয়ার মতো অবস্থা।’’ আর এক জখম লতিকা তরফদারের আঘাত অবশ্য তেমন গুরুতর নয়। ঘটনার চার দিন পরেই তাঁকে শক্তিনগর জেলা হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। সিপিএম-এর তরফে যে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল তাতেই মোটামুটি তাঁর চিকিত্সার খরচ উঠে গিয়েছে। সিপিএমের অর্থসাহায্যেই চিকিত্সা হচ্ছে জখম কিশোর রাজীব মণ্ডলেরও। রাজীবের পায়ের হাড় গুঁড়িয়ে গিয়েছে। কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিত্সা চলছে। তার বাবা দিনমজুর রাজকুমারবাবু বলেন, ‘‘ছেলের চিকিত্সার পিছনে অনেক টাকা যাচ্ছে। কিন্তু আমাকে খরচ করতে হচ্ছে না। সিপিএম থেকেই সমস্ত টাকা দিচ্ছে। সিপিএমের লোকজন হাসপাতালে আসেন এখনও। খোঁজ খবর নেন। বিমান বসুও একবার এসেছিলেন।’’
সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এস এম সাদি বলেন, “এই সরকারের আমলে চোলাই মদ খেয়ে মারা গেলে মৃতের পরিবার ক্ষতিপূরণ পায়। কিন্তু দুষ্কৃতীদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়েও সাহায্য মেলে না। আমরা যতটা পারি সাহায্য করেছি আহত ও নিহতদের পরিবারকে। আহতরা যে ক্রমে সেরে উঠছে, এটাই স্বস্তির।”
নিহত অপর্ণাদেবীর শূন্যস্থান অবশ্য পূরণ হওয়ার নয় কোনও ক্ষতিপূরণেই। তাঁর রক্তে ভিজে যাওয়া মাটি তাই সংগ্রহ করে রেখেছেন গ্রামবাসী। স্মৃতিস্তম্ভ বানিয়ে যতটা স্মৃতি রক্ষা করা যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy