আরে, রাজা মাস্টার না! একসঙ্গে পার্টি করেছি। মনে আছে? আমি নিরঞ্জন মণ্ডল। তোমাদের দেখে এখন আবার বেরিয়ে এলাম।
তেঁতুলিয়া মোড়ের চায়ের দোকানে বসে লাল উত্তরীয়ে চশমাটা মুছে প্রৌঢ় নিরঞ্জনের হাত দু’টো ধরলেন রাজা মাস্টার। পেশায় হাইস্কুলের শিক্ষক। আপাতত মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের দেওয়াল রাজা মাস্টারের পাশেই সিপিএম প্রার্থীর পোশাকি নামের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। বদরুদ্দোজা খান। নিরঞ্জনদের যিনি বলছেন, “তোমাদের সঙ্গে চাই!”
পুরনো বন্ধুদের বেরিয়ে আসার খবরে উত্তেজনা স্বাভাবিক। কিন্তু নিজের লক্ষ্যে বদরুদ্দোজা ধীর-স্থির। লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে শ’খানেক কিলোমিটার জুড়ে বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় বিএসএফের সঙ্গে গ্রামবাসীদের সমস্যা, নদীর ভাঙনে বিপর্যয়, আর্সেনিক মুক্ত জলের দাবি স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ এই সব প্রশ্ন সংসদে তুলতে হবে। বাসিন্দাদের মুখোমুখি হয়ে, যতটা ঘরোয়া ভাবে সম্ভব, বোঝাচ্ছেন সিপিএমের নতুন প্রার্থী। বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রশ্নের কথাও বলছেন সহজ ভঙ্গিতে। মাস্টারমশাই যেন পড়া বোঝাচ্ছেন! তাঁর কথায়, “ইউপিএ-২ জমানায় নজিরবিহীন দুর্নীতি আর মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। দুর্নীতির দায়ে মন্ত্রীরা জেলে গিয়েছেন! আবার রাজ্যে তৃণমূলও দুর্নীতিতে হাত পাকিয়েছে। এক সাংসদ জেলে! এরাই বেরিয়েছে ভোট চাইতে!”
জিয়াগঞ্জের ভিতরে দূর থেকে একেবারে দূরবর্তী গ্রাম মহম্মদপুরে দলীয় এক কর্মীর বাড়িতে দলবল নিয়ে যিনি বসে আছেন, তাঁর ভোট চাওয়ার ভঙ্গি এত নরম-সরম নয়। দশ বছর পরে ফের লোকসভা ভোটে লড়ছেন। প্রায়ান্ধকার ঘরে বিছানার এক পাশে জেলার তৃণমূল নেতা সাগির হোসেন, অন্য পাশে সমাজবাদী পার্টি ছেড়ে শাসক দলে যোগ দেওয়া ভগবানগোলার বিধায়ক চাঁদ মহম্মদ। তৃণমূল প্রার্থী মহম্মদ আলি বলছেন, “ভোট চাইছি তৃণমূল দল এবং নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে। মানুষকে বলছি, পুতুল নাচ আপনারা দেখেছেন। সুতো দিয়ে পুুতুলকে পিছন থেকে নাচানো হয়। নেত্রীকে যত আসন দেবেন, দিল্লির সরকারের পুুতুল নাচের সুতো তত বেশি তাঁর কাছে থাকবে!”
রাজ্যে দল ক্ষমতায় থাকার কল্যাণেই হবে হয়তো, তৃণমূল প্রার্থীর সঙ্গে মেলা লোক! কিন্তু জেলায় তৃণমূল মানে অন্তত চারটে বড় গোষ্ঠী। ছোট ছোট উপ-শিবির আছে আরও। এত গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব সামলে এই জেলায় কংগ্রেস এবং বামকে টপকে পুতুল নাচের কারিগর হওয়া সম্ভব? মুর্শিদাবাদ জেলা তৃণমূলের সভাপতি মহম্মদের মন্তব্য, “গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব আবার কী? গণতান্ত্রিক দলে মতান্তর থাকবে না? কই কংগ্রেসের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব তো চোখে পড়ে না আপনাদের! আমরা এখানে একটু দুর্বল বলে বারবার গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের কথা!” সাগিরের পাশে বসে ছবি তুলে তৃণমূল প্রার্থী প্রমাণ করে দিলেন, গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব নামে কোনও ব্যাপারের নামই তাঁরা শোনেননি!
এ সব কাণ্ড-কারখানা শুনে শীতল হাসছেন জলঙ্গি-ফেরত মান্নান হোসেন। দশ বছরের কংগ্রেস সাংসদের সহাস্য প্রশ্ন, “গোটা দেশে কত আসন পেলে সরকারের সুতো হাতে নেওয়া যায়, জানে ওরা? নিজেদের দলটা আগে সামলাক! তার পরে দেশ নিয়ে ভাববে!” খাগড়াঘাট রোডে মান্নানের বাড়ির দো-তলার সোফায় বসে ৬ হাজার ‘ফর্ম ১০’-এ অক্লান্ত সই করতে করতে এক গৃহবধূও হাসছেন। “যে দলের নেত্রী কী বলেন আর কী করেন ঠিক নেই, তাদের নিয়ে ভেবে কী হবে?” হাসতে হাসতেই জানতে চাইছেন বুলবুল বেগম। সাংসদের সহধর্মিণী এবং তাঁর নির্বাচনী এজেন্ট। যকৃতের জটিল অসুখে খাওয়াদাওয়ার সমস্যা, বাইরে বেশি দৌড়ঝাঁপও বন্ধ। তবে পরিবার সুখী। বাবা লড়ছেন ভোটে, মা প্রচার এবং নির্বাচনী দফতর সামলাচ্ছেন আর ছেলে যুব কংগ্রেসের হয়ে এখানে-ওখানে ছুটছেন। বুলবুলের কথায়, “অধীর চৌধুরী প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি, সৌমিক হোসেন (ছেলে) প্রদেশ যুব কংগ্রেসের সভাপতি। মুর্শিদাবাদে কংগ্রেসে নতুন জোয়ার এসেছে!”
হোসেন পরিবারের বাবা-মা-ছেলেকে অবশ্য একসঙ্গে এক জায়গায় প্রচারে দেখার কোনও সুযোগ নেই। মান্নান-পত্নীর কথায়, “উনি জলঙ্গি গেলে আমি ভগবানগোলা! সবাই মিলে এক জায়গায় গিয়ে কী করব?” ভোটের সময় ছাড়া অবশ্য বেশি বেরোনও না বুুলবুল। “স্কুলে পড়াতে যাই। আর অন্য সময় কোথায় জল চাই, কোথায় রাস্তা চাই, এ সব নিয়ে সাংসদের কাছে যা দাবি আসে, দেখভাল করি।” হোম মিনিস্টারের এই হোম-ওয়ার্ক যে কাজে দেয়, এলাকা ঘুরলে মালুম হয়। সাংসদ মান্নানের কাজের ফলক বহু জায়গায় গেঁথে আছে। মান্নানও তাই অনায়াসে বলতে পারেন, “এ বার পঞ্চায়েত ভোটের সময়টায় অসুস্থ ছিলাম। বাকি সময় ১২ মাস মানুষের সঙ্গেই আছি। ভোটে আর নতুন করে কী বলব?”
পাঁচ বছর আগে সাংসদ হিসাবে মান্নানের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হয়েছিল তৃণমূলের সঙ্গে জোট প্রার্থী হিসাবে। তার দু’বছর পরে জোট থাকা সত্ত্বেও মুর্শিদাবাদ লোকসভা এলাকার মধ্যে পাঁচটি বিধানসভা কেন্দ্রই (পরে অবশ্য চাঁদ দল বদলেছেন) দখলে নিয়েছিল বামফ্রন্ট, কংগ্রেস পেয়েছিল দু’টি। এ বার জোট নেই। ময়দানে আছে তৃণমূল। বিজেপি প্রার্থী, সিবিআইয়ের প্রাক্তন কর্তা সুজিত ঘোষের প্রচার এখানে খানিকটা স্তিমিত হলেও কিছু ভোট তাঁদের আছে। আরএসপি-র বিধায়ক ঈদ মহম্মদ বোঝাচ্ছেন, “প্রার্থী যে-ই হোন, সব জায়গাতেই কংগ্রেসের ভোট এ বার কমবে। নিজেদের ভোট ধরে রাখতে পারলেই আমাদের সুযোগ অনেক বেশি।” সাংসদের হ্যাটট্রিকের পথে বাধা হিসাবে এ সব অঙ্কের ভাবনা অবশ্য খাগড়াঘাটের বাড়ির বড় দরজার ও’পারে ঢুকছে না। “১২ মাস যাকে পাশে পাওয়া যায়, তার আবার ভয় কী?” প্রচারে দুই মেরুর অভিযাত্রী হলেও প্রত্যয়ে এক জায়গায় মিলে যাচ্ছে সাংসদ-এজেন্ট দম্পতির সুর!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy