শাসক দলের নেতার নজর থেকে বাদ পড়ছে না খালও!
নদিয়ার বেথুয়াডহরী ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের মাঠপাড়ার মোড়ে খাল বুজিয়ে দলীয় কার্যালয় তৈরির অভিযোগ উঠল তৃণমূলের স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান মনোরঞ্জন মালাকার ওরফে মনা-সহ বেশ কয়েকজন কর্মী সমর্থকদের বিরুদ্ধে। দিনকয়েক আগে পড়শি জেলা, মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘির জিনদিঘি গ্রামে স্কুলের জমি দখলের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের এক যুব নেতার বিরুদ্ধে। সেখানে পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছিল যে, বাধ্য হয়ে স্কুল কতৃর্পক্ষ ওই নেতার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে।
বেথুয়াডহরী মাঠপাড়ার এই বিষয়টি জানিয়েও স্থানীয় বেশ কিছু লোকজন জেলাশাসক, নাকাশিপাড়ার বিডিও, ব্লক ভূমি সংস্কার আধিকারিক ও অতিরিক্ত জেলাশাসকের (ভূমি ও ভূমি সংস্কার) কাছে লিখিত অভিযোগও দায়ের করেছেন। কিন্তু বলাই বাহুল্য, এখনও পর্যন্ত টনক নড়েনি প্রশাসনের কর্তাদের। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, তৃণমূলের নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ বলেই সব জেনেও চুপ করে আছে প্রশাসন। নাকাশিপাড়ার বিডিও হেমন্ত ঘোষের দায়সারা জবাব, “অভিযোগ পেয়েছি। তদন্তও শুরু হয়েছে।”
কিন্তু ঘটনাস্থলে গেলেই অবশ্য মালুম হয় তদন্তের বহর! মাঠপাড়া এলাকায় পনেরো ফুট চওড়া সেই খালের চেহারা এখন চেনাই দায়। খালের বেশ কিছুটা জায়গা মাটি ফেলে ভরাট করে পিলার তুলে জোরকদমে চলছে দলীয় কার্যালয় নির্মাণের কাজ। নাকাশিপাড়ার পশ্চিম জগদানন্দপুর মৌজা থেকে শুরু করে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ ওই খালটি বিল্বগ্রামের কাছে চূর্ণী নদীতে মিশেছে। স্থানীয় মাঠপাড়া, মোরগখোলা, খিদিরপুর, কাঠলবেড়িয়া, বিল্বগ্রামের উপর দিয়ে ওই খাল বয়ে গিয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে খবর, বেশ কয়েক মাস আগেই ওই খাল ও তার পার্শ্ববর্তী জমি নজরে পড়ে এলাকার তৃণমূলের প্রভাবশালী কিছু নেতার। তারপর মাসখানেক আগে থেকেই অবাধে সেই খাল বুজিয়ে দলীয় কার্যালয় নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। অভিযোগ, এই গোটা বিষয়টির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তৃণমূলের দাপুটে নেতা বলে পরিচিত বেথুয়াডহরী ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান মনোরঞ্জনবাবু। বাকি কাজ সামলাচ্ছেন তাঁর অনুগামীরা।
বেথুয়াডহরী ১ পঞ্চায়েতের বিরোধী দলনেতা কংগ্রেসের পুলক সিংহ বলেন, “মনোরঞ্জনবাবু নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এমন বেআইনি কাজ করাচ্ছেন। আমরা প্রশাসনের কাছে অভিযোগও জানিয়েছি। কিন্তু কেউই কোনও পদক্ষেপ করছেন না।” তাঁর কথায়, “এমন ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগেও ওখানে এ ভাবেই দলীয় কার্যালয় তৈরির চেষ্টা করেছিল তৃণমূল। তখন বাধা দেওয়ায় তারা আর এগোতে পারেনি। তবে এ বার ওরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় জনাকয়েক বাসিন্দার কথায়, “প্রশাসনকে তো বটেই, তৃণমূলের জেলা নেতাদেরও বিষয়টি জানানো হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা কেউই এই বিষয়টাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। ফলে অবাধে মনোরঞ্জনবাবু সেখানে দোকান ঘর ও দলীয় কার্যালয় তৈরি করছেন। প্রতিবাদ করতে গেলে দেখে নেওয়া হবে বলেও হুমকি দেওয়া হচ্ছে।”
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বেথুয়াডহরী ১ ও বিল্বগ্রাম পঞ্চায়েতের বেশ কিছু এলাকার নিকাশি ব্যবস্থা পুরোপুরি নির্ভর করে এই খালের উপর। মাঠপাড়া-সহ বিস্তীর্ণ এলাকার জল ওই খাল দিয়েই চূর্ণী নদীতে মেশে। ২০০০ সালে বন্যার সময় ওই খালই কার্যত পরিত্রাতার ভূমিকা নিয়েছিল। ফলে এই খালটি এ ভাবে বুজিয়ে ফেললে আখেরে ক্ষতি হবে এই এলাকারই।
প্রসঙ্গত, বেথুয়াডহরী ১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে ওই খালের একাংশ সংস্কার করেছিল। চলতি অর্থবর্ষেও ওই খাল সংস্কারের জন্য উদ্যোগী হয়েছে পঞ্চায়েত। কিন্তু খোদ পঞ্চায়েতেরই উপপ্রধানের বিরুদ্ধে খাল ভরাটের অভিযোগ ওঠায় পুলকবাবুর কটাক্ষ, “রক্ষকই ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। একদিকে একশো দিনের টাকায় খাল সংস্কার হচ্ছে। অন্য দিকে উপপ্রধান নিজেই খাল ভরাট করছেন!”
যাঁর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ সেই মনোরঞ্জনবাবু অবশ্য কোনও রাখঢাক না রেখেই বলছেন, “খালটা তো আর কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। ওটা সরকারের। এমনিই পড়েছিল। তাই ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে ওখানে একটা পার্টি অফিস করছি। তবে দোকানটা আমার এক আত্মীয়ের। আমি সেটা দেখভাল করেছি মাত্র। এই নিয়ে তো কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। বিরোধীরা এটা নিয়ে অহেতুক রাজনীতি করছে।”
মনোরঞ্জনবাবুর যুক্তির মান্যতা দিয়েই নাকাশিপাড়ার বিধায়ক তৃণমূলের কল্লোল খাঁ বলছেন, “দলের ছেলেরা উদ্যোগী হয়ে অকেজো খালের উপরে একটা দলীয় কার্যালয় তৈরি করছে। এতে দোষের কী আছে! এমন তো সব দলই করে। মনোরঞ্জন ওই এলাকার ভাল সংগঠক, দাপুটে নেতা। তাই বিরোধীরা অহেতুক ওকে হেনস্থা করার চেষ্টা ক রছে।”
নদিয়ার অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভূমি সংস্কার) অভিজিৎ ভট্টাচার্য বলেন, “আমরা কোনও অভিযোগ এখনও পর্যন্ত পাইনি। অভিযোগ পেলে বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” আর নদিয়ার জেলাশাসক পি বি সালিমকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy