অশান্তি এড়াতে বহরমপুর কলেজে নোটিস। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।
কলেজে কলেজে অশান্তি চলেছেই! আর সেই অশান্তির জেরে কোথাও কলেজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কতৃর্পক্ষ। কোথাও বা নির্বাচনে সরাসরি প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চেয়ে আবেদন জানাচ্ছেন অধ্যক্ষ। কোথাও গোলমালের জেরে বাড়ানো হচ্ছে সিসিটিভি। এর জেরে পড়াশোনা তো বটেই আইন-শৃঙ্খলারও অবনতি হয়েছে জেলার বেশ কিছু কলেজে।
বৃহস্পতিবার থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য মুর্শিদাবাদের সালার মুজাফ্ফর আহমেদ কলেজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। বুধবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ওই কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ-সহ অন্যান্য শিক্ষকদের ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখায় বিবদমান দুই ছাত্র সংগঠন ছাত্র পরিষদ ও তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। প্রথমে ছাত্র পরিষদ ঘেরাও করে রাখে। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই তা তুলেও নেয়। এর পরেই দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত তৃণমূল ছাত্র পরিষদের ঘেরাওয়ের মুখে পড়েন কলেজ শিক্ষকরা। ঘেরাও মুক্ত হওয়ার পরেও ‘চাপ’ সহ্য করতে না পেরে ওই রাতেই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদ থেকে ইস্তফা দেন কাকলি ভৌমিক। তাঁর ইস্তফাপত্র কলেজ পরিচালন সমিতির কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার কথাও তিনি স্বীকার করেন। এই অবস্থায় কার্যত ‘অভিভাবকহীন’ হয়ে পড়ে ওই কলেজ। ফলে কলেজ কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটি ঘোষণা করতে বাধ্য হন।
সালার কলেজের ঘটনায় এ দিন কান্দির মহকুমাশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে ছাত্র পরিষদ। জেলা ছাত্র পরিষদের সহ-সভাপতি জয়দেব ঘটক বলেন, “তৃণমূল ছাত্র পরিষদ ঘেরাও করে কলেজ অধ্যক্ষের উপরে মানসিক চাপ সৃষ্টি করার ফলেই তিনি ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছেন। গোটা বিষয়টি খতিয়ে দেখে কলেজের পঠনপাঠনের উপযুক্ত পরিবেশ দ্রুত ফিরিয়ে আনার দাবি জানানো হয়েছে মহকুমাশাসকের কাছে।” কান্দির মহকুমাশাসক বিজিনকুমার কৃষ্ণ বলেন, “কলেজ কর্তৃপক্ষ ও পড়ুয়াদের সঙ্গে বৈঠক করে অবিলম্বে মিমাংসা সূত্র বের করা হবে।”
যদিও ইস্তফার সিদ্ধান্তে অনড় সদ্য পদত্যাগী অধ্যক্ষ কাকলিদেবী। তিনি বলেন, “কোনও পরিস্থিতিতেই আমি ইস্তফাপত্র প্রত্যাহার করব না। ইস্তফাপত্র প্রত্যাহারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমার উপরে চাপ সৃষ্টি করলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ছুটি নিয়ে বাড়িতে বসে থাকব।” সেই সঙ্গে কলেজ অধ্যক্ষের পদ সামাল দিতে গিয়ে তাঁর জীবনহানি হতে পারে বলেও কাকলিদেবী আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “আমার বাড়ি চাকদহ হলেও আমি কাটোয়া থেকে নিয়মিত যাতায়াত করে কলেজ করি। অধ্যক্ষের পদে থাকলে আমার জীবনহানিও ঘটতে পারে। এমনকী যাতায়াতের পথে বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনার কথাও উড়িয়ে দিচ্ছি না।”
শান্তিতে কলেজ ভোট করার জন্য কর্তৃপক্ষ থেকে পুলিশ-প্রশাসন সকলেই ওপরেই চাপ রয়েছে। কলেজের ‘গার্ড ফাইল’ থেকে পড়ুয়াদের নাম ও ঠিকানা সংগ্রহ করার জন্য শনিবার নোটিশ জারি করার পরে এ দিন তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে বহরমপুর কলেজ কর্তৃপক্ষ। অধ্যক্ষ সমরেশ মণ্ডল বলেন, “কলেজ নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গার্ড ফাইল থেকে ছাত্রছাত্রীদের নাম ও বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করার বিষয়টি অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। নোটিশ জারি করে সেই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েও দেওয়া হয়েছে।”
আচমকা কেন এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হল তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সমরেশবাবু বলেন, “এর আগে গার্ড ফাইল থেকে নাম ও ঠিকানা সংগ্রহ করা নিয়ে গণ্ডগোলের জেরে কলেজ বন্ধ ছিল। ফের বড় ধরণের গণ্ডগোলের আশঙ্কা করছি। পরিস্থিতি কলেজ কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাই কলেজের ভোট পরিচালনার বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপের দাবি জানানো হয়েছে প্রশাসনের কাছে।” কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, রাজ্যের বিভিন্ন কলেজে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। এই কলেজেও সামান্য ঘটনা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রসংগঠনগুলি পরস্পরের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে জীবনহানিরও আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। অধ্যক্ষ বলেন, “বিষয়টি নিয়ে আমি নিজে যেমন আতঙ্কিত, তেমনি শিক্ষক-শিক্ষিকারাও তাঁদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। এই অবস্থায় জেলা প্রশাসন নির্বাচনের কাজ পরিচালনা করুক। আমরা অব্যাহতি চাইছি।” বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ অধ্যক্ষ কল্যাণাক্ষ ঘোষ বলেন, “কলেজ শিক্ষকদের দিয়ে নির্বাচন পরিচালনা করলে কিছুটা অসুবিধা তো হয়। জেলা প্রশাসন যদি সরাসরি কলেজ ভোট পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করলে ভালই হবে।”
এর আগে একই ভাবে নদিয়ার চাপড়া বাঙ্গালঝি কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকে ইস্তফা দেন কৃষ্ণগোপাল রায়। কিন্তু ইস্তফাপত্র প্রত্যাহারের জন্য তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় জেলা তৃণমূলের সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্তের বাড়িতে। সেখানে ইস্তফাপত্র প্রত্যাহারের জন্য ওই অধ্যক্ষকে বোঝানো হয়। অভিযোগ ছিল, তৃণমূল ছাত্র পরিষদ পরিচালিত চাপড়া বাঙ্গালঝি কলেজের ছাত্র সংসদ কয়েক মাস আগে পরীক্ষায় ‘অবাধে টুকতে দিতে হবে’ বলে দাবি তোলে। অধ্যক্ষ ওই দাবির কাছে মাথা নোয়াতে রাজি না হওয়ায় গেটে তালা বন্ধ করে ঘেরাও করে রেখে বিক্ষোভ দেখায় ওই ছাত্র সংগঠন। এমনকী অধ্যক্ষের সঙ্গে অশালীন আচরণও করে বলে অভিযোগ। তার পরেই অধ্যক্ষ পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এ দিন ফোনে কৃষ্ণগোপালবাবু বলেন, “কলেজে ভোটের সময়ে গণ্ডগোল এড়াতে অতিরিক্ত ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।” কলেজ কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা, এসএফআই এবং এবিভিপি সর্বশক্তি দিয়ে কলেজ ভোটে লড়বে। এই অবস্থায় পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে কলেজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্ছিদ্র করতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশ কর্মী মোতায়েন করার দাবিও জানিয়েছে কলেজ কতৃর্পক্ষ।
ভর্তি নিয়ে চাপ সৃষ্টি করার কারণে পদত্যাগ করেছিলেন শান্তিপুর কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ চয়ন ভট্টাচার্য। পরে কলেজের দায়িত্ব নেন রতনেশ মিশ্র। এ দিন রতনেশবাবু বলেন, “আমার ঘরে সিসিটিভি লাগানো হয়েছে। এখনও ভোট গ্রহণের দিন ঘোষণা হয়নি। তা সত্ত্বেও এখন থেকেই কলেজ ভোটের সময়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভিডিওগ্রাফি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কলেজের নিরাপত্তার ভার পুলিশ-প্রশাসনের উপরে থাকবে।” সম্প্রতি করিমপুর ও বেতাই কলেজেও ছাত্র-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। আশা-আশঙ্কায় দুলছে ওই দুই কলেজ কর্তৃপক্ষও।
(সহ প্রতিবেদন: কৌশিক সাহা, সুস্মিত হালদার)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy