অঙ্কন: অশোক মল্লিক
হতবাক, র্যাঞ্চো। বাদলা রাতে সেই অসম্ভব পরিস্থিতিতে অনভ্যস্থ হাতে কোনওরকমে প্রসবের পরে সদ্যোজাতটিকা কোলে নিয়ে মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল, ‘‘... লাথ মারা!’’
মঙ্গলবার সন্ধ্যাভর আঁধার সদর হাসপাতালে, টর্চের আলোয় প্রসবের পরে তেমনই অস্ফূটে চিকিৎসকেরা কিছু বলেছেন নাকি!
জানা নেই। তবে, থ্রি ইডিয়েটস-এর সেই অবাস্তব কাণ্ডটাই ঘটিয়ে ফেলেছেন কৃষ্ণনগর সদর হাসপাতালের চিকিৎসকেরা।
টানা বিদ্যুৎ বিভ্রাটে ঘুটঘুটে অন্ধকার ওয়ার্ড। বন্ধ ওটি। এ দিকে, প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছে মেয়েটি। বাইরে দাঁড়িয়ে ঘামছেন ডাক্তার-নার্স। সিজারের জন্য সমস্ত প্রস্তুতি সারা। কিন্তু অস্ত্রোপচার যে সম্ভব নয়। কারণ অপারেশন থিয়েটারে আলো নেই। ভিতরে যে ঘটঘুটে অন্ধকার!
শেষে উপায় হল, টর্চ আর ইমার্জেন্সি লাইটেই ওটি করলেন ডাক্তারেরা।
কর্তব্যরত এক নার্সের কথায়, “কাজটা মারাত্মক ঝুঁকির ছিল। একটু ভুল হয়ে গেলেই কিন্তু কেউ ছেড়ে কথা বলত না!”
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার দুপুর থেকে শুরু হয় বিদ্যুৎ বিভ্রাট। প্রথমে জেনারেটর দিয়ে চেষ্টা হয়েছিল তার মোকাবিলার। কিন্তু কী আশ্চর্য, একে একে তিনটি জেনারেটরই
দেহ রাখে।
বিদ্যুৎ বণ্টন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, দুপুর আড়াইটে নাগাদ ভাতজাংলার কাছে ৩৩ হাজার ভোল্ট বিদ্যুতের তারের উপরে গাছের ডাল পড়ে যায়। সদর হাসপাতাল-সহ গোটা কৃষ্ণনগর অন্ধকার হয়ে যায় তার জেরেই। সেই শুরু বিপর্যয়ের।
এই মুহুর্তে হাসপাতালের দু’টো জেনারেটর। একটি ৬২ কেভি-এর। সেটা ওটি-সহ পুরনো বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। সেটা চালু করতে না করতে যন্ত্রাংশ খারাপ হয়ে বিকল হয়ে বসে যায়। ডাক পড়ে মিস্ত্রির। বেশ খানিকক্ষণ চেষ্টা চরিত্রের পর তারা ব্যর্থ হলে খবর দেওয়া পূর্ত দফতরের ইলেকট্রিক্যাল বিভাগকে। ছুটে আসেন তাদের ইঞ্জিনিয়াররা। ব্যর্থ হন তাঁরাও। এরই মধ্যে আলোর অভাবে দুপুর তিনটে থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয় অস্ত্রোপচার। সাড়ে চারটা নাগাদ বিদ্যুৎ চলে আসায় আবার ওটি চালু করে অস্ত্রোপচার শুরু হয়। কিন্তু আধ ঘন্টা যেতে না যেতে ফের লোডশেডিং।
সিন্ধান্ত হয় ৫০০ কেভি-র বড় জেনারেটর চালিয়ে মাদার-চাইল্ড হাবে আলোর ব্যবস্থা করা হবে। সেখান থেকে যদি কোনও ভাবে লাইন টেনে ওটি চালু করা যায়।
কিন্তু কিছুক্ষণ চলার পরে সেটার ভিতরে হাওয়া ঢুকে বন্ধ হয়ে যায় যন্ত্রটি। এ বার সেটা সারাইয়ের কাজে হাত লাগান ইঞ্জিনিয়াররা। এরই মধ্যে পরিস্থিতি আঁচ করে ইমারজেন্সি আলো কিনে আনার ব্যবস্থা করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। নিয়ে আসা হয় কয়েক ডজন মোমবাতি।
কিন্তু ওটি?
চরম অসহায় বোধ করতে থাকেন সকলে। সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ বড় জেনেরাটর চালু করা গেলেও ওটিতে আলোর ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। সেই সময় ফের বিদ্যুৎ আসে। কিন্তু উড়ে যায় হাসপাতালের লাইনের লাইটিং অ্যারেস্টার নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ। চেষ্টা করেও সে’টি আর মেরামত করা যায়নি।
এই ভাবে একের পর এক বিপর্যয়ে নাজেহাল অবস্থা ডাক্তারদের। ঠিক করা কিছু একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। ৮ জন প্রসূতিকে রেফার করা হল অন্যত্র। কিন্তু হাসপাতাল কতৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিলেন, “না। এত রাতে কোনও রেফার নয়। যা করতে হবে এই হাসপাতালেই।” প্রসূতিদের নানা ভাবে সাহস জোগাতে থাকেন কর্তব্যরত নার্সরা। তার পর টর্চের আলোয়...।
কর্তব্যরত চিকিৎসক সুধীররঞ্জন সরকার বলেন, “প্রথমেই আমরা সিদ্ধান্ত নিই, যে যেমন করেই হোক এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করব। কোন মা বা বাচ্চার ক্ষতি হতে দেওয়া যাবে না। ভাল লাগছে আমরা সেটা করতে পেরেছি।”
এরই মধ্যে ভাড়া করে নিয়ে আসা হয় জেনারেটর। ন’টা নাগাদ সেটা চালু করে গোটা ওয়ার্ডে আলোর ব্যবস্থা করা গেলেও ওটির ভিতরে আলোর ব্যবস্থা করা গেল না। শেষ পর্যন্ত রাত সাড়ে দশটা নাগাদ ওটির ভিতরে আলোর ব্যবস্থা করা যায়। আবার নতুন করে সিজারের প্রস্তুতি শুরু হয়। এরই মধ্যে ঠিক হয়ে যায় বিদ্যুৎ সংযোগ। রাত সাড়ে তিনটে পর্যন্ত একের পর এক ১২টি সিজার। হাসপাতালের সুপার পার্থ দে বলেন, “গোটা হাসপাতাল যেন একটা টিম হয়ে উঠেছিল। সকলে কাঁধে কাধ মিলিয়ে যে ভাবে এই বিপর্যয়ের মোকাবিলা করলেন, আমি গর্বিত।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy