রানাঘাটে বৃদ্ধ সন্ন্যাসিনীকে গণধর্ষণের প্রতিবাদে আগরতলায় বিক্ষোভ মিছিল। ছবি: বাপি রায়চৌধুরী।
রানাঘাটে আর ফিরতে চান না নির্যাতিতা মাদার সুপিরিয়র।
শুক্রবার ভোরে দিল্লি পাড়ি দিয়েছেন সন্ন্যাসিনী। রাজধানীর বাংলা সাহেব মার্গের মেরি-জেসাস কনভেন্ট স্কুলই আপাতত তাঁর ঠিকানা। দশ দিন পরে ফের একজন স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ এবং একজন মনোবিদের তাঁকে দেখার কথা আছে।
সন্ন্যাসিনী নিজেই তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছিলেন, তিনি আর রানাঘাটের কনভেন্ট স্কুলে ফিরে যেতে চান না। গত বুধবার, যে দিন কার্ডিনাল ক্লিমিস মাদারকে দেখতে গিয়েছিলেন রানাঘাটের হাসপাতালে, সে দিনই ঠিক হয়েছিল, মাদার সুপিরিয়রকে নিয়ে যাওয়া হবে দিল্লিতে। এ দিন দিল্লি পৌঁছে মাদার দুপুর একটা নাগাদ রানাঘাট হাসপাতালের সুপারকে মোবাইলে বার্তা পাঠিয়ে জানান, তিনি নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছেন।
কেন রানাঘাটে থাকলেন না সন্ন্যাসিনী? কলকাতার আর্চবিশপ টমাস ডি’সুজা শুক্রবার বলেন, “ওই সন্ন্যাসিনীর মানসিক শান্তি ও বিশ্রামের জন্য তাঁকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়েছে।” সন্ন্যাসিনীর ঘনিষ্ঠরাও জানিয়েছেন, মাদার তাঁদের বলেছেন, যেখানে তাঁর উপরে এমন পৈশাচিক অত্যাচার হয়েছে, সেখানে ফিরে গেলে তিনি মানসিক শান্তি পাবেন না। সেখানে নিয়মিত দেখা করতে আসবে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা, আসবেন অভিভাবক ও অন্যরাও। অনেকের সামনে অনেক প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে তাঁকে। প্রশ্ন না করলেও অনেকে হয়তো চোখে-মুখে সমবেদনার ছবি এঁকে সামনে ঘুরে বেড়াবেন। এ সমস্ত থেকেই দূরে থাকতে চান সন্ন্যাসিনী। তিনি যে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত, সেখানকার কর্তাব্যক্তিরাও তাঁকে রানাঘাটে তো নয়ই, এ রাজ্যেই রাখতে চান না বলে একটি সূত্রের খবর। ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান অফিস রোমে। সন্ন্যাসিনীর পাশে দাঁড়াতে গত রবিবার সেখান থেকে যে প্রতিনিধি এসেছেন, তিনি সন্ন্যাসিনীকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী বলেই জানাচ্ছেন সূত্রটি।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও মনে করছে, কিছু দিনের জন্য দেশ ছেড়ে যেতে পারেন ওই সন্ন্যাসিনী। মন্ত্রকের শীর্ষস্তরের এক কর্তা জানান, পোপ ফ্রান্সিসের অভিষেকের দু’বছর পূর্তি উপলক্ষে আর্চবিশপ সালভাটোর পেনাচ্চিও কয়েক দিন আগে দিল্লিতে একটি নৈশভোজের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলেন। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা কর্তারা জানতে পেরেছেন, সেখানেই প্রস্তাব ওঠে যে, মাদার সুপিরিয়র যাতে শারীরিক ও মানসিক ভাবে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন, তাই কিছুদিনের জন্য তাঁকে বিদেশে পাঠানো হোক। গোয়েন্দা সূত্রে এই প্রস্তাবের কথা জানতে পেরে দিল্লি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে খবর দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। মন্ত্রকের তরফে বৃদ্ধ সন্ন্যাসিনীর পাসপোর্ট সংক্রান্ত তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে কলকাতায়।
কেন বিমানবন্দরে খবর দিয়ে রাখল মন্ত্রক? এর ব্যাখ্যা দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ওই কর্তা বলেন, রানাঘাটের ঘটনাটি খুবই স্পর্শকাতর। এতে দেশের ভাবমূর্তির উপরে আঁচ পড়েছে। সন্ন্যাসিনী দেশ ছেড়ে যাবেন, না দেশে থাকবেন সেটা তাঁর সিদ্ধান্ত। সরকার এ ব্যাপারে তাঁর কাছে গিয়ে আগাম প্রশ্নও করতে পারে না। এ ব্যাপারে আর্চবিশপ কোনও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কি না, তা জিজ্ঞাসা করাটাও শিষ্টতার মধ্যে পড়ে না। কিন্তু সন্ন্যাসিনী কোথায় যাচ্ছেন তা সরকারের গোচরে থাকা উচিত। কারণ, মাদার সুপিরিয়র দেশ ছাড়লে সেটিও আন্তর্জাতিক স্তরে আলোচনার বিষয় হবে। আর সেই কারণেই বিমানবন্দরে বার্তা পাঠিয়ে বিষয়টির উপরে নজর রাখার কথা বলা হয়েছে।
কী ভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে মাদারকে নিয়ে যাওয়া হল দিল্লিতে? সূত্রের খবর, রানাঘাট থেকে দিল্লি যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। তখনই এয়ার ইন্ডিয়ার উড়ানের চারটি টিকিট কাটা হয়। ঠিক হয়, শুক্রবার ভোরের বিমানে কলকাতা থেকে দিল্লি উড়ে যাবেন তিনি। সঙ্গে যাবেন রানাঘাট কনভেন্টের সুপার সিস্টার শান্তি। সূত্রের খবর, সন্ন্যাসিনীকে বৃহস্পতিবারেই রানাঘাট থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হবে বলে ঠিক হয়। শহরের এক কনভেন্টে রাত কাটিয়ে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তিনি রওনা হবেন বিমানবন্দরের দিকে। কিন্তু বাদ সাধেন সন্ন্যাসিনী নিজেই। জানা গিয়েছে, তিনি নিজে রানাঘাট থেকে সরাসরি বিমানবন্দরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আর সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী বৃহস্পতিবার রাত সওয়া দু’টো নাগাদ রানাঘাট হাসপাতালে হাজির হন কনভেন্টের প্রতিনিধিরা। রাতেই কনভেন্টের পক্ষ থেকে লিখিত ভাবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে সন্ন্যাসিনীকে তাঁরা নিয়ে যেতে চান।
তার আগে ওই দিন রাত ১১টায় হাসপাতাল ছাড়েন হাসপাতাল সুপার অতীন্দ্রনাথ মণ্ডল। হাসপাতাল সূত্রের খবর, তখনও তাঁকে জানানো হয়নি যে গভীর রাতে সন্ন্যাসিনী হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাবেন। অন্যান্য দিনের মতো সে দিন সন্ধ্যায়ও অতীনবাবু গিয়ে সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও কিছু বুঝতে পারেননি। রাত সওয়া দু’টোয় যখন তিনি ফোন পান, তখন তিনি বাড়িতে। হাসপাতালে তখন ডিউটিতে ছিলেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সঞ্চিতা রায়। তিনি অতীনবাবুর স্ত্রী। তিনি ছাড়াও ছিলেন চিকিৎসক সৌরভ রায়চৌধুরী এবং চিকিৎসক তাপস মল্লিক। অতীনবাবু বলেন, “আমরা তো বুধবারেই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। ডিসচার্জ সার্টিফিকেটও লিখে ফেলা হয়েছিল। তার পরে তিনি যখন খুশি চলে যেতেই পারেন।” অতীনবাবুর নির্দেশে মাদারকে ছাড়ার আগে সঞ্চিতাদেবী তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। তাঁর রক্তচাপ ও নাড়ির গতি স্বাভাবিক আছে কি না তা দেখা হয়। শুক্রবার অতীনবাবু বলেন, “মাদার একেবারেই সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। মানসিক ও শারীরিক ভাবে পুরোপুরি স্থিতিশীল ছিলেন। তাঁর মানসিক জোর দেখে আমরাই অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম।”
হাসপাতাল সূত্রের খবর, সন্ন্যাসিনীকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যেতে সিস্টার শান্তি, কনভেন্টের প্রতিনিধি ছাড়াও এসেছিলেন মহকুমা শাসক ও মহকুমা পুলিশ অফিসার। হাসপাতালের কেবিন থেকে হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি পর্যন্ত মাদার হেঁটেই আসেন। গাড়িতে ওঠার আগে তিনি হাসপাতালের সমস্ত চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, নার্সদের সঙ্গে দেখা করে ধন্যবাদ জানান। সন্ন্যাসিনীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি অ্যাম্বুল্যান্সও নিয়ে আসেন কনভেন্টের প্রতিনিধিরা। তবে রানাঘাট থেকে বিমানবন্দর, এতটা পথ তাঁকে এ ভাবে ছেড়ে দিতে রাজি হননি অতীনবাবু। তাঁর নির্দেশে চিকিৎসক তাপস মল্লিক হাসপাতালেরই একটি গাড়ি নিয়ে রানাঘাট থেকে কলকাতা বিমানবন্দর পর্যন্ত অ্যাম্বুলেন্সের পিছনে পিছনে যান। রানাঘাট থেকে সেই কনভয় রওনা হয় রাত পৌনে তিনটেয়।
বিমানবন্দর সূত্রে জানা গিয়েছে, সন্ন্যাসিনী সেখানে পৌঁছন ভোর সাড়ে চারটেয়। বাইরে তখন অন্ধকার। সেখানেই অ্যাম্বুল্যান্সে অপেক্ষা করেন তাঁরা। কথা হয় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। ভোর সওয়া পাঁচটা নাগাদ অ্যাম্বুল্যান্স পৌঁছয় চার নম্বর গেটের কাছে। সেখানে অপেক্ষা করছিল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের গাড়ি। সন্ন্যাসিনী এবং সিস্টার শান্তিকে সেই গাড়িতে তোলা হয়। তাঁরা দু’জন গাড়ি করে ঢুকে যান বিমানবন্দরের টারম্যাকে। যেখানে বিমান দাঁড়িয়ে থাকে। বাকি দু’জন অন্য যাত্রীদের মতোই টার্মিনালের ভিতরে ঢুকে যান। এয়ার ইন্ডিয়ার দিল্লিগামী বিমান ছিল ৫৫ নম্বর পার্কিং বে-তে। বিমানের সামনের দরজায় লাগানো ছিল ২০ নম্বর অ্যারোব্রিজ। অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে গিয়ে দাঁড় করানো হয় বিমানের পিছনের দরজার কাছে। অন্য যাত্রীরা ওঠার আগে সেই দরজা দিয়ে সন্ন্যাসিনীকে তুলে দেওয়া হয় বিমানে। ৩সি নম্বর আসনে বসে তিনি দিল্লি উড়ে যান।
রানাঘাট কনভেন্টের ওই সন্ন্যাসিনী আদতে রাজস্থানের বাসিন্দা। নাইজেরিয়া থেকে এসে বছরখানেক আগে তিনি রানাঘাটের ওই কনভেন্টে সুপিরিয়র হিসাবে যোগ দেন। এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, অত্যন্ত ভদ্র ও নম্র স্বভাবের মানুষ ছিলেন ওই বৃদ্ধা। শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতেই বেশি ভালবাসতেন।
স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, মাদার বেশির ভাগ সময় স্কুল আবাসনের দোতলাতেই থাকতেন। মাঝেমধ্যে নীচে নেমে পড়ুয়াদের সঙ্গে গল্পগুজব করতেন।
কনভেন্টের এক কর্মী অণিমা মণ্ডল (বরখাস্ত হওয়া এক নিরাপত্তারক্ষীর স্ত্রী) এই ক’দিন হাসপাতালে ওই সন্ন্যাসিনীকে দেখাশোনা করছিলেন। এ দিন মাদার চলে যাওয়ায় কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বলেন, “অন্য দিনের মতো এ দিনও সকাল সাতটায় হাসপাতালে যাই। গিয়ে জানতে পারি উনি চলে গিয়েছেন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy