জলে ডুবে ধুলিয়ানের ৮ নম্বর ওয়ার্ড। ডান দিকে, রঘুনাথগঞ্জের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের জমেছে হাঁটু সমান জল। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়
শেষ পর্যন্ত আশঙ্কাই সত্যি হল!
বছরের প্রথম টানা বর্ষণে ভাসল রঘুনাথগঞ্জ ও ধুলিয়ান। শুক্রবারের ভারি বর্ষণে জঙ্গিপুর হাসপাতাল, আবাসন, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল, বিদ্যুৎ দফতর, ইন্দিরাপল্লি, সুকান্তপল্লি, আমবাগান কলোনি, নীলরতন কলোনি, ফিল্ড কলোনি, সব্জি বাজার-সহ রঘুনাথগঞ্জ শহরের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এখন থইথই করছে জল। কোথাও জল হাঁটু পর্যন্ত, কোথাও তা কোমর ছাড়িয়েছে। আরও শোচনীয় অবস্থা ধুলিয়ানের। ইতিমধ্যেই ধুলিয়ানের ২১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৫টি এখন জলে ডুবে রয়েছে। কমবেশি ১৬ হাজার মানুষ জলবন্দি। বর্ষা শুরুতেই অনুপনগর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ধুলিয়ান পুরভবন, শহরের দু’টি বালিকা বিদ্যালয় চত্বরে জল থই থই করছে। শনিবারে বৃষ্টি কম হওয়ায় রঘুনাথগঞ্জের পরিস্থিতি কিছুটা নাগালে এলেও ধুলিয়ানের পরিস্থিতি যে ভয়ঙ্কর তা স্বীকার করেছেন পুরপ্রধান সুবল সাহা। জঙ্গিপুরে ক্ষমতায় বামেরা, ধুলিয়ানে তৃণমূল। তবে দুই শহরের বাসিন্দারা এর জন্য পুরসভার দিকেই আঙুল তুলেছেন।
পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে শুক্রবার শহর ঘুরে দেখেন জঙ্গিপুরের মহকুমাশাসক প্রিয়াঙ্কা সিংলা। জঙ্গিপুর হাসপাতালে গিয়ে সুপার ও পুর-কর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসেন মহকুমাশাসক। ঘণ্টা দুয়েক ধরে বৈঠকের পর ঠিক হয় বিভিন্ন এলাকায় নিকাশিনালার আবর্জনা তুলে জল সরানোর কাজ শুরু করবে পুরসভা। কিন্তু বৃষ্টি ও জমা জলের জন্য নিকাশিনালার আবর্জনা সরানো যায়নি বলে জানিয়েছেন জঙ্গিপুরের পুরপ্রধান মোজাহারুল ইসলাম।
মহকুমাশাসক বলেন, ‘‘শহরের নিকাশি ব্যবস্থা খুবই খারাপ। এ দায় সম্পূর্ণ ভাবে পুরসভার। তবে আগামী সপ্তাহে নিকাশি সাফাই নিয়ে বৈঠক ডাকা হচ্ছে।’’ এ দিকে, ধুলিয়ানের পুরপ্রধান সুবল সাহা বলেন, ‘‘নিকাশি ব্যবস্থা বলে কিছুই নেই শহরে। পাম্প বসিয়ে জল তুলে ফেলা ছাড়া কোনও উপায় নেই। বৃষ্টি না ধরলে তা সম্ভব নয়।’’ গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে কয়েক বার ঝেঁপে বৃষ্টি হয়। পরদিন ভোর থেকে শুরু হয় টানা বৃষ্টি। আর তাতেই রঘুনাথগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকায় ‘বানভাসি’ অবস্থা।
রঘুনাথগঞ্জ শহরেই অবস্থিত জঙ্গিপুর মহকুমা হাসপাতাল। সকালে রোগীরা ঘুম ভাঙতেই দেখেন বাইরের নর্দমার জল ঢুকে ভাসছে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ-সহ বারান্দা, ওয়ার্ডে। জলে ভাসছে হাসপাতালের কর্মী ও চিকিৎসক আবাসনের নীচতলা। হাসপাতালের সুপার শাশ্বত মণ্ডল বলেন, ‘‘নিকাশিনালা জবরদখল হয়ে যাওয়ায় এই বিপত্তি। বর্ষার শুরুতেই যদি এই হাল হয় তবে ভরা বর্ষায় কী হবে তা ভেবে আতঙ্কিত আমরা।’’
রঘুনাথগঞ্জকে ঘিরে রেখেছে পূর্বে ভাগীরথী, পশ্চিমে কালমণ ও খড়খড়ি নদী। সে কারণে ভরা বর্ষাতেও বরাবরই শহরের জনপদ ছিল যথেষ্ট নিরাপদ। এক সময় কালমণ ও খড়খড়ি দু’টি নদীই চওড়ায় প্রায় দেড়শো মিটারেরও বেশি ছিল। কিন্তু যত দিন গিয়েছে নদীর দু’পাড়ে কলোনির সংখ্যা বাড়ায় জবরদখলের জেরে নদী সরু হয়ে গিয়েছে। পরিস্থিতি এমনই যে কোথাও তা ৩০ মিটারে নেমে এসেছে কোথাও বা তারও কম। ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের এসইউসি কাউন্সিলর অনুরাধা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, জঙ্গিপুর পুরসভায় তিন দশক ধরে ক্ষমতায় রয়েছে বামেরা। মূল সড়কের দু’পাশে প্রায় ১০ মিটার চওড়া বহু পুরনো নিকাশিনালা রয়েছে। নিকাশির জল নিয়ন্ত্রণের জন্য কয়েকটি লকগেটও ছিল। এখন নিকাশিনালা জবরদখল হয়ে গিয়েছে। ম্যাকেঞ্জি রোডের দু’পাশে নালাও বন্ধ। হাসপাতাল বরাবর দু’পাশে নালার উপর চিকিৎসকদের চেম্বার, ওষুধের দোকান, শৌচাগার গড়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা নালার উপর ঘর বানিয়ে নিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘পুরকর্তারা চোখ বন্ধ করে রেখেছেন বলেই নিকাশিনালা বেদখল হয়ে গিয়েছে। শহর জলে ভাসছে।’’
নিকাশিনালা জবরদখলের কথা জঙ্গিপুরের পুরপ্রধান মোজাহারুল ইসলামও স্বীকার করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এই সব নির্মাণ বেআইনি। নিকাশিনালাগুলিকে সক্রিয় করতে তা ভাঙতে হবে। আগামী সপ্তাহে মহকুমাশাসক পূর্ত দফতর, জেলা পরিষদ, পুরসভা ও পুলিশ কর্তাদেরকে নিয়ে বৈঠকে বসবেন। সেখানেই ঠিক হবে কী ভাবে ওই সব নির্মাণ ভেঙে ফেলা হবে। নিকাশিনালা দ্রুত সাফ করা হবে।’’
অন্য দিকে, ধুলিয়ানে অপরিকল্পিত ভাবে যেখানে সেখানে ঘরবাড়ি গজিয়ে উঠেছে শহরে। এমনিতেই ধুলিয়ান শহরে বেশির ভাগই ‘কাটান এলাকা’ অর্থাৎ নিচু এলাকা। ফলে জলের স্বাভাবিক নিকাশি বলে কিছু নেই। কয়েকটি ওয়ার্ড সারা বছরই জলের তলায় থাকে। আগে নিয়মিত পাম্প লাগিয়ে সে জল বের করে দেওয়া হত। এখন তারও বালাই নেই। যেটুকু নিকাশি ব্যবস্থা রয়েছে সেখানেও প্লাস্টিক থেকে বিড়ির পাতা, দৈনন্দিন প্রাতঃকৃত্য সবই চলছে।
তৃণমূলের ব্লক সভাপতি কাওসার আলি বলেন, ‘‘শহরের অবস্থা অনেকটা হাতের তালুর মতো। চারিদিক উঁচু। ফলে জল বেরোতে পারে না। অনুমতি ছাড়াই সস্তায় জমি কিনে যেখানে সেখানে গজিয়ে উঠেছে ঘরবাড়ি। তাই একদিনের বৃষ্টিতেই ধুলিয়ানের এই জল ছবি।’’ পুরপ্রধান সুবল সাহা বলছেন, ‘ভুগর্ভস্থ্ নিকাশি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারলে ধুলিয়ানের এই জল ছবি বদলানো সম্ভব নয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy