Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

ঋণ আদায়ে অভিনব পদক্ষেপ বহরমপুরে

কোনও হুমকি নয়। বাড়িতে লোক পাঠিয়ে কোনও সবক শেখানোও নয়। ঝুট-ঝামেলার কথা মুখে আনাও পাপ। এ যেন নিখাদ গাঁধীগিরি। যা দেখে অনেকেরই মনে পড়ে যেতে পারে লাগে রহো মুন্নাভাইয়ের সেই ‘গেট ওয়েল সুন’ লেখা সেই পোস্টারের কথা! বকেয়া ঋণ আদায় করে ব্যাঙ্ক বাঁচাতে এ ভাবেই পোস্টার নিয়ে পথে নামলেন কর্মীরা।

এ ভাবেই বকেয়া ঋণ আদায়ের চেষ্টা। বহরমপুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।

এ ভাবেই বকেয়া ঋণ আদায়ের চেষ্টা। বহরমপুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।

শুভাশিস সৈয়দ
বহরমপুর শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৫ ০৩:১০
Share: Save:

কোনও হুমকি নয়। বাড়িতে লোক পাঠিয়ে কোনও সবক শেখানোও নয়। ঝুট-ঝামেলার কথা মুখে আনাও পাপ। এ যেন নিখাদ গাঁধীগিরি। যা দেখে অনেকেরই মনে পড়ে যেতে পারে লাগে রহো মুন্নাভাইয়ের সেই ‘গেট ওয়েল সুন’ লেখা সেই পোস্টারের কথা!

বকেয়া ঋণ আদায় করে ব্যাঙ্ক বাঁচাতে এ ভাবেই পোস্টার নিয়ে পথে নামলেন কর্মীরা। ‘অনুগ্রহ করে ব্যাঙ্কের বকেয়া ঋণ পরিশোধন করুন’ লেখা পোস্টার হাতে কোথাও অনাদায়ী গ্রাহকদের বাড়ির সামনে, কোথাও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাঙ্ক কর্মীরা ‘নীরব প্রতিবাদ’ জানান। ব্যাঙ্কের ঋণ আদায়ে বুধবার সকাল থেকে বহরমপুর ও শহর লাগোয়া ১১টি জায়গায় চলে ওই নীরব ধরনা কমর্সূচি পালন করল একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মী সংগঠন। সংগঠনের রাজ্য কমিটির সম্পাদক গৌতম সরকার বলেন, “ব্যাঙ্ক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়েও যাঁরা দীর্ঘ দিন পরিশোধ করছেন না, তাঁরা কিন্তু নিজেদের সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সেই সব অনাদায়ী গ্রাহকদের প্রকৃত চেহারা সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরা আমাদের উদ্দেশ্য।”

এ দিন সকাল ১১টা থেকে শুরু হয় ওই কর্মসূচি। শুরুতেই গোরাবাজার নিমতলা মোড়ের কাছে একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সামনে যান ওই সংগঠনের সদস্যরা। ব্যাঙ্ক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়েও ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক ঋণ পরিশোধ করছেন না বলে অভিযোগ। ব্যাঙ্কের নিয়ম অনুযায়ী বার বার চিঠি পাঠিয়ে তাগাদা দিয়েও কোনও কাজ না হয়ে শেষ পর্যন্ত এমন পদক্ষেপ বলে জানান ওই সদস্যরা। ইংরেজি ও বাংলায় লেখা পোস্টার হাতে ওই দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন সংগঠনের সদস্যরা। তা দেখে কৌতূহলী মানুষের ভিড় জমে যায়। পথচলতি মানুষের মধ্যে গুঞ্জনও শোনা যায়। কিছু ক্ষণ নীরব প্রতিবাদ জানিয়ে ওই এলাকা ছেড়ে ব্যাঙ্ক কর্মীরা চলে যান গোরাবাজার কসাইখানা এলাকায় এক গৃহস্থের বাড়িতে। তিনি ঋণ নিয়ে বাড়ি করার পরেও ব্যাঙ্ক ঋণ পরিশোধ করছেন না বলে অভিযোগ।

গৌতমবাবু বলেন, “বহরমপুরের নামী এক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মালিকের নাম যেমন অনাদায়ী তালিকায় রয়েছে, তেমনি রয়েছে স্কুল শিক্ষকের নামও। তাঁরা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়েও পরিশোধ করছেন না।” ঋণ আদায় করতে এ দিন ওই ব্যাঙ্কের কর্মী সংগঠনের যে ১৫ জন সদস্য এ দিন পথে নেমেছিলেন তাঁদের মধ্যে ১০ জন ব্যাঙ্ক কর্মী এবং পাঁচ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মী। ওই ১০ জন ব্যাঙ্ক কর্মী অবশ্য এ দিনের কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার জন্য আগাম ছুটিও নিয়েছিলেন।

এ দিন গোরাবাজার, খাগড়া, স্বর্ণময়ী, মধুপুর, কাদাই এলাকা ছাড়াও বানজেটিয়া এবং ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ে রাধারঘাট এলাকায় যান ওই সংগঠনের সদ্যসরা। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বাড়ি, ফ্ল্যাট, পানীয় জলের কারখানা তৈরির জন্য ওই সব এলাকার অনেকেই ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেননি। সব মিলিয়ে এ দিন ওই কর্মীরা যে ১১টি জায়গায় ঘুরেছেন সেই সব এলাকায় মোট বকেয়া ঋণের পরিমাণ প্রায় দেড় কোটি টাকা। গৌতমবাবুর অভিযোগ, “শহরের বিভিন্ন ব্যবসায়ী থেকে সমাজের উঁচু তলার বেশ কিছু মানুষ রয়েছেন যাঁদের ঋণ পরিশোধ করার সামর্থ্য থাকলেও তাঁরা তা করছেন না।” তিনি জানান, ঋণ পরিশোধ করলে ওই অর্থ জেলার বিভিন্ন প্রান্তিক চাষিদের কৃষি ঋণ দেওয়া যেত। কিন্তু ঋণ আদায় না হওয়ায় ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের তরফে অনেক ক্ষেত্রে তা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কৃষি ঋণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রান্তিক চাষিরা। তিনি বলেন, “আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় দেখেছি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা পারিবারিক কোনও কারণ ছাড়া প্রান্তিক চাষিরা ঋণ শোধ করছেন।”

ব্যাঙ্ক কর্মীদের ওই উদ্যোগকে স্বাগত জানান ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ। ওই ব্যাঙ্কের গোরাবাজার শাখার ডেপুটি ম্যানেজার সূর্যকুমার বিশ্বাস বলেন, “লোক জানাজানি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় অনেকেই দ্রুত ঋণ পরিশোধ করে দেবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।” ব্যাঙ্কের মুখ্য আঞ্চলিক অধিকর্তা সোমনাথ দত্ত বলেন, “ওই উদ্যোগের ফলে ঋণগ্রহীতারা যদি সময় মতো ঋণ পরিশোধ করেন, তার চেয়ে ভাল কিছু হয় না। কারণ ঠিক সময়ে ঋণ পরিশোধ না হলে নতুন ঋণ নিতে যাঁরা ব্যাঙ্কে আসছেন, তাঁদেরও সন্দেহের চোখে দেখা হয়। বকেয়া পরিশোধ করলে আগামী দিন ঋণ দিতে সুবিধে হবে।”

তবে অভিনব ওই পদক্ষেপের ফলও মিলতে শুরু করেছে। বহরমপুরের এক ঋণগ্রহীতা জানান, ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ ঋণের টাকা আদায়ের জন্য বাড়িতে চিঠি পাঠান। অনেক সময় ফোন করেও দেখা করতে বলেন। বড়জোর কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় বলেই তিনি জানতেন। কিন্তু বাড়ির সামনে ব্যাঙ্কের লোকজন ‘বকেয়া পরিশোধ করুন’ লেখা পোস্টার বুকে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন, আর সেই দৃশ্য অন্যরা দেখছে, এমনটা তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “এ তো মানসম্মানের ব্যাপার! ঢের হয়েছে মশাই, আর নয়, এ বার ব্যাঙ্কের বকেয়া টাকা দ্রুত শোধ করে দেব।” এ দিনের ওই কর্মসূচির পরেই বহরমপুরের এক নামী ব্যবসায়ী ফোনে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের যোগাযোগ করে ঋণ পরিশোধ করারও অঙ্গীকার করেছেন বলে রাষ্ট্রায়ত্ত ওই ব্যাঙ্ক সূত্রে জানা গিয়েছে।

তারপরেই ওই সংগঠনের সদস্যরা হাসতে হাসতেই বলছেন, “ঋণ চাইলে ফের ঋণ পাওয়া যায়। কিন্তু মান সম্মান গেলে তো আর ফিরে পাওয়া যায় না। এই সার কথাটা অন্তত ওঁরা যে বুঝতে পেরেছেন এটাই ঢের।”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE