বড় গোস্বামীর বাড়ির বিগ্রহ। বড় গোস্বামী বাড়ি ( ডান দিকে)।— নিজস্ব চিত্র
উৎসব এগিয়ে চলে কাহিনির হাত ধরে। কাহিনি থেকেই উপাদান সংগ্রহ করে ইতিহাস। কখন যেন কাহিনিটাই সত্যি হয়ে ওঠে।
শান্তিপুরের আনাচে কানাচে কান পাতলেই শোনা যায় নানা কাহিনি কিংবদন্তি। ভাঙারাসের শোভাযাত্রা থেকে রথযাত্রা, বাবলার সপ্তম দোল থেকে জগদ্ধাত্রী পুজো কিংবা গাজি মিঞার বিয়ের মেলা। শান্তিপুরের সব উৎসব অনুষ্ঠানের গায়েই জড়ানো আছে আশ্চর্য সব কাহিনির নক্সাদার রঙিন চাদর। ভক্তদের বিশ্বাসে তা-ই সত্য।
রাস উৎসবের জন্য শান্তিপুরের খ্যাতি দেশ জোড়া। যদিও উৎসবের নাম এখানে ভাঙারাস। কিন্তু কেন এমন নামকরণ? সূত্র খুঁজতে কাহিনি ভরসা।
পুরাণ বলে, দ্বাপরে স্বয়ং মহাদেব ছদ্মবেশে অনুপ্রবেশ করায় ভেঙে গিয়েছিল শ্রীকৃষ্ণের রাস। কেননা রাসোৎসবে পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া কোনও পুরুষের প্রবেশাধিকার ছিল না। ধরা পড়ে মহাদেব বলেছিলেন, কলিতে তিনি সকল ভক্তকে রাস দর্শন করাবেন। বলা হয় অদ্বৈতাচার্যই প্রথম শান্তিপুরে রাসের সূচনা করেন এবং ভক্তরা মনে করেন তিনি মহাদেবের অংশ। বিশ্বাস, দ্বাপরের ভাঙা রাস কলিতে ফের শুরু করলেন অদ্বৈতাচার্য, তাই উৎসবের পরিচিত হল ভাঙা রাস নামে। তবে অদ্বৈতাচার্যের সৃষ্ট রাসের কোনও আড়ম্বর ছিল না।
দীন বৈষ্ণব নির্জন কুটিরের নিকানো উঠোনে গুচ্ছ গুচ্ছ তুলসি গাছ। ভিতর থেকে ভেসে আসা ধূপের ম ম করা সুবাস তুলসি মঞ্জরির গন্ধের সঙ্গে মিশে এক অনির্বচনীয় আবহ রচনা করেছে। বাইরে কার্তিকী পূর্ণিমার হিমেল জ্যোৎস্নায় চরাচর আবৃত। কুটির অভ্যন্তরে প্রদীপের মৃদু আলোয় উজ্জ্বল শ্রীকৃষ্ণের একক মূর্তি। সামনে বসে বৈষ্ণব চূড়ামণি জোড় করে প্রার্থনা করে চলেছেন, “রাসোৎসবঃ সংপ্রবৃতো গোপী মণ্ডল মণ্ডিতঃ, যোগেশ্বরেণ কৃষ্ণেন তাসাং মধ্যে দ্বয়োদ্বয়োঃ।” হয়ত এ ভাবেই রাস উদযাপন করতেন আচার্যদেব। কিন্তু সেই নির্জনতার সাধনা কী ভাবে বিশ্বজনীন উৎসবে বদলে গেল?
উত্তর খুঁজতে আমাদের ফিরে যেতে হবে কাহিনির আশ্রয়েই। স্থানীয় ইতিহাস বলে, অদ্বৈত পৌত্র মথুরেশ গোস্বামীর আমল থেকেই শান্তিপুরের ভাঙা রাস উৎসবের চেহারা ধারণ করে। একবার বড় গোস্বামী বাড়ি থেকে চুরি হয়ে যায় শ্রীশ্রী রাধারমণ বিগ্রহ। তত দিনে মথুরেশের দেহান্ত হয়েছে। চারি দিকে হইহই পড়ে গেল। কয়েকদিন পরেই পার্শ্ববর্তী দিগনগর গ্রামের এক দিঘি থেকে উদ্ধার হয় সেই মূর্তি। রাধারমণের এই খোয়া যাওয়ার ঘটনায় তৎকালীন গোস্বামী সমাজ খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। তাঁরা ভাবলেন, হয়ত একা আছেন বলেই এ ভাবে অন্তর্হিত হয়েছিলেন রাধারমণ।
মনে রাখতে হবে, সেই সময়ে এক সঙ্গে দুই বিগ্রহের পুজো শুরু হয়ে গিয়েছে। চৈতন্যের কথা মতোই সেই প্রবণতা শুরু হয়। বঙ্গদেশে তাঁর বিগ্রহ পুজো শুরু হয়ে গিয়েছে শুনে বিচলিত হয়েছিলেন সেই সন্ন্যাসী। তিনি নিজে জগন্নাথ বিগ্রহের সামনে তখন নিঃশেষে সমর্পিত। তিনি চাননি, দেবতাকে ছেড়ে দেবকল্পকে আশ্রয় করুক মানুষ।
কিন্তু সে কথা শুনবে কে? কৃষ্ণের পুজো তখন শুরু হয়েছে। চৈতন্যের ইচ্ছাতেই কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার পুজোও প্রচলিত হল। নবদ্বীপে চৈতন্যকে রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তি বলে মনে করাও হত। গৌর-নিতাই পুজোরও সে সময় থেকেই শুরু বলে অনেক ইতিহাসবিদ বলে মনে করেন।
গোস্বামী পরিবারের প্রধানেরাও সিদ্ধান্ত নিলেন সঙ্গে শ্রী রাধিকা থাকলে হয়ত এই অঘটন ঘটত না। এই ভাবনা থেকেই রাধারমণের পাশে শ্রীরাধিকা মূর্তি স্থাপনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। সেই অনুযায়ী আটত্রিশ কেজি ওজনের এক ফুট উচ্চতার অষ্টধাতুর ‘শ্রীমতীকে’ রাধারমণের পাশে স্থাপন করে যুগলে অভিষিক্ত করা হয়। দিনটি ছিল রাস পূর্ণিমা। বলা বাহুল্য, এই অনুষ্ঠানকে স্মরণীয় করে রাখতে সেই সময়ে সাড়ম্বর উৎসবের আয়োজন করা হয়। তারপর থেকে প্রতি বছর রাস পূর্ণিমাতে জাঁকজমক পূর্ণ অনুষ্ঠান হতে থাকে বড় গোস্বামী বাড়িতে।
কিন্তু এত বড় একটা ঘটনা শুধু মাত্র নাট মন্দিরের চার দেওয়ালে মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, তা আবার হয় নাকি? গোটা শান্তিপুরের মানুষকে রাধারমণ-শ্রীমতীর যুগলমূর্তি দেখাতে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করলেন বড় গোস্বামী বাড়ির অনুগামী খাঁ চৌধুরীরা। রাস উৎসবের তৃতীয় দিনে সেকালের এই বিখ্যাত ধনী পরিবারের অর্থানুকূল্যে যুগল মূর্তির শোভাযাত্রা প্রথম শান্তিপুরের পথে নেমেছিল। প্রদক্ষিণ করেছিল বিভিন্ন অঞ্চল। সেই শোভাযাত্রাই পরে ভাঙা রাসের শোভাযাত্রা হিসাবে খ্যাত হয়েছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বিগ্রহবাড়ি এই শোভাযাত্রায় যোগ দিতে শুরু করে। শান্তিপুর বিগ্রহ বাড়ি সমন্বয় সমিতির তত্ত্বাবধানে অত্যন্ত সুষ্ঠ ভাবে পরিচালিত ভাঙা রাসের শোভাযাত্রা এখন বাংলার প্রধান উৎসবগুলির মধ্যে অন্যতম। চার দিনের এই উৎসব প্রসঙ্গে সমিতির সাধারণ সম্পাদক শশাঙ্ক চক্রবর্তী জানান, গৌর আনা ঠাকুর নামে খ্যাত অদ্বৈতাচার্যের লীলাভূমি শান্তিপুরের রাস চার দিনের উৎসব। রাস পূর্ণিমার দিন উৎসবের সূচনা। পরের দিন মাঝের রাস। তৃতীয় দিন ভাঙা রাসের শোভাযাত্রা। চতুর্থ দিন কুঞ্জভঙ্গের মধ্য দিয়ে শেষ হয় রাসোৎসবের।
শান্তিপুরের ভাঙা রাসে কুঞ্জভঙ্গ একটি বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে। বিগ্রহ বাড়ি সমন্বয় সমিতির প্রদ্যোত গোস্বামী জানিয়েছেন, সারা রাত শোভাযাত্রার শেষে বিভিন্ন গোস্বামী বাড়ির বিগ্রহ এনে পুনরায় রাস মঞ্চে বসানো হয়। সকাল থেকে দুপুর সেখানে পালা কীর্তন, তরজা গান ইত্যাদি চলে। দুপুরের পর রাস কুঞ্জ ভেঙে গোস্বামী বংশের উত্তর পুরুষেরা শুদ্ধ বস্ত্র পড়ে যুগলবিগ্রহকে নাচের তালে তালে দেবালয়ে নিয়ে আসেন। এই অনুষ্ঠনের নাম ঠাকুর নাচ। দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই অনুষ্ঠান দেখতে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেন। ঠাকুর নাচ শেষে বিগ্রহ নিজ নিজ মন্দিরে স্থাপিত হওয়ার পড়ে ভক্তেরা চামরদান করেন। সব চেয়ে বড় কথা বছরে এই একটি দিনই মহিলারা শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহকে স্পর্শ করার সুযোগ পান। কুঞ্জভঙ্গের বেদনায় শেষ হয় রাস উৎসব।
শান্তিপুরের অধিকাংশ বিগ্রহবাড়ির প্রধান উৎসব ভাঙা রাস। কিন্তু তা ছাড়াও বারো মাসে তেরো পার্বণ নিয়েও বাঁচে শান্তিপুর। রাসের পরেই যে উৎসব শান্তিপুরের প্রাণের উৎসব তা হল অদ্বৈতাচার্যের আবির্ভাব তিথি। প্রতি বছর মাকড়ি সপ্তমীতে এই উৎসব পালিত হয়। সাত দিন ধরে উৎসব চলে প্রতিটি গোস্বামী বাড়িতে। শ্রীমদনগোপাল জিউ মন্দির, ছোট গোস্বামী বাড়ি, বড় গোস্বামী বাড়ি সহ বিভিন্ন বাড়ি থেকে বের হয় সীতানাথের নগর পরিক্রমা। উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয় অদ্বৈত পাট বাবলায়।
রাধাকৃষ্ণের দোল উৎসব শান্তিপুরের আরও একটি বড় উৎসব। দোল পূর্ণিমা থেকে শুরু করে বিভিন্ন গোস্বামী বাড়িতে পঞ্চম দোল, সপ্তম দোল, নবম দোল অনুষ্ঠিত হয়। রথযাত্রায় পথে নামে বড় গোস্বামী বাড়ি এবং গোকুলচাঁদের রথ। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজোও শান্তিপুরের একাধিক গোস্বামী বাড়িতে হয়। গোকুলচাঁদের বাড়ি এবং বড় গোস্বামী বাড়িতে হয় পুজো। বড় গোস্বামী বাড়িতে অবশ্য দুর্গার ভিন্ন রূপ দেবী কাত্যায়নীর পুজো প্রসিদ্ধ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy