Advertisement
২১ নভেম্বর ২০২৪
Jadavpur University Student Death

‘র‍্যাগিং কী জিনিস বুঝলাম’! চাকরিতে যোগ দিতে গিয়ে হেনস্থার শিকার যাদবপুরে মৃত পড়ুয়ার মা

কাজে যোগ দিতে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের হেনস্থার মুখে পড়ার অভিযোগ যাদবপুরে মৃত ছাত্রের মায়ের। তাঁর দাবি, ছেলের নামের ফলকে তাঁর চোখের সামনেই গোবর লেপে দেওয়া হয়।

representational image

ছেলের নামাঙ্কিত হাসপাতালেই র‌্যাগিংয়ের শিকার মা! গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

প্রণয় ঘোষ
বগুলা শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১২:২৯
Share: Save:

যাদবপুরের হস্টেলে অস্বাভাবিক ভাবে মৃত্যু হওয়া পড়ুয়ার মাকে চাকরিতে পদোন্নতি দিয়েছে রাজ্য সরকার। কথা ছিল, নতুন পদে যোগ দিয়ে ছেলের নামে নামাঙ্কিত বগুলা গ্রামীণ হাসপাতালে বসেই কাজ করবেন তিনি। কিন্তু কাজে যোগ দিতে গিয়ে চরম হেনস্থার মুখে পড়তে হল সদ্য পুত্রহারা মাকে। ছেলের নামে নামাঙ্কিত হাসপাতালে ছেলের নামফলকে মায়ের সামনেই লেপে দেওয়া হল গোবর। মৌখিক আক্রমণের হাত থেকে বাঁচলেন না মৃত পড়ুয়ার মা-বাবাও। সব দেখে অকালমৃত পড়ুয়ার মায়ের প্রতিক্রিয়া, ‘‘র‌্যাগিং কী জিনিস, বুঝলাম!’’

প্রস্তুতি প্রায় শেষ। ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে বগুলা গ্রামীণ হাসপাতাল চত্বর। প্রধান ফটকের সামনে বসেছে তোরণ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা মতো আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের অপেক্ষায় যাদবপুরের হস্টেলে মৃত পড়ুয়ার নামে নামাঙ্কিত ‘স্বপ্নদীপ গ্রামীণ হাসপাতাল’। ওই দিনই ছেলের নামাঙ্কিত হাসপাতালে ‘অ্যাটেনড্যান্ট’ পদে কাজে যোগ দেওয়ার কথা মৃত পড়ুয়ার মায়েরও। যথাসময়ে হাসপাতালে পৌঁছয় শোকার্ত পরিবার। তার পর আচমকাই বদলে যায় হাসপাতালের চিত্র। অভিযোগ, স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ মৃত পড়ুয়ার পরিবারকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। মায়ের চোখের সামনেই গোবর লেপে মুছে দেওয়া হয় হাসপাতালের ফলকে মৃত পড়ুয়ার নাম। যা নিজের চোখে দেখতে পারেননি, জ্ঞান হারান মা। অভিযোগ, পরিবারকে ঘিরে ধরে চলতে থাকে অকথ্য গালিগালাজ এবং কটূক্তির বন্যা। পুলিশের উপস্থিতিতে কোনও ক্রমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। এই ঘটনার পর মৃত পড়ুয়ার মায়ের বিহ্বল প্রতিক্রিয়া, ‘‘র‍্যাগিং কী জিনিস, আজ বুঝলাম!’’

নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতার সঙ্গে দেখা করেছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হস্টেলে রহস্যজনক ভাবে মৃত ছাত্রের পরিবার। মুখ্যমন্ত্রী মৃত পড়ুয়ার প্রতি সম্মান জানিয়ে বগুলা গ্রামীণ হাসপাতালকে ‘স্বপ্নদীপ গ্রামীণ হাসপাতাল’-এ পরিবর্তিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন। পরিবারের পাশে দাঁড়াতে মৃত পড়ুয়ার মাকে আশাকর্মী থেকে পদোন্নতি দিয়ে ওই হাসপাতালের অ্যাটেনড্যান্ট পদে নিয়োগের প্রস্তাব দেওয়া হয়। দু’টি প্রস্তাবে পরিবার সম্মতি জানানোয় ওই দিন সন্ধ্যায় প্রশাসনিক প্রস্তুতি শুরু হয়। আনন্দবাজার অনলাইনকে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন মৃত পড়ুয়ার মা। বলেছিলেন, ‘‘ছেলের নামাঙ্কিত হাসপাতালে প্রত্যেক দিন কাজ করব। সবার মুখে ছেলের নাম শুনব, এটা ভেবেই এক কথায় ওখানে কাজে যেতে রাজি হই। আমার মনে হবে, ছেলেটা আমায় জড়িয়ে ধরে আছে।’’ বুধবার আনুষ্ঠানিক ভাবে হাসপাতালের নতুন নামকরণ এবং মৃত পড়ুয়ার মায়ের চাকরিতে যোগদানের দিন স্থির হয়।

পুলিশ সূত্রে খবর, নির্ধারিত দিনে মৃত পড়ুয়ার মা কাজে যোগ দিতে গেলে কয়েকটি স্থানীয় সংগঠন প্রতিবাদ জানায়। মৃত পড়ুয়ার পরিবারকে লক্ষ্য করে কটূক্তি এবং অশ্লীল ইঙ্গিতের অভিযোগও করা হয়েছে পরিবারের তরফে। মৃত পড়ুয়ার মা এবং গোটা পরিবারের সামনে গোবর লেপে মুছে ফেলা হয় হাসপাতালে মৃত পড়ুয়ার নামাঙ্কিত অংশ। ঘটনার তাৎক্ষণিকতায় আবারও জ্ঞান হারান মৃত পড়ুয়ার মা। ভেঙে ফেলা হয় উদ্বোধনের জন্য তৈরি তোরণ। খুলে ফেলা হয় হাসপাতালে সাজানো ফুল। কিছু ক্ষণের মধ্যেই কার্যত লন্ডভন্ড হয়ে যায় গোটা হাসপাতাল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশ কোনও রকমে পরিস্থিতি সামাল দেয়।

গোটা ঘটনার সাক্ষী মৃত পড়ুয়ার মা বলেন, ‘‘র‍্যাগিং কী জিনিস, বুঝলাম! চোখের সামনে যখন ছেলের নাম মুছে দিচ্ছে, মনে হচ্ছে আমার ‘খোকা’ একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে। ওদের হাতেপায়ে কত ধরলাম নামটুকু রাখার জন্য, কিছুতেই শুনল না। কী হত, আমার ছেলের নামটা থাকলে?’’ মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত মৃত পড়ুয়ার বাবাও। কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের বলা হচ্ছে, মৃত ছেলেকে বিক্রি করে নিজেরা বিক্রি হয়েছি! এটা শোনার পর আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না।’’ মৃত পড়ুয়ার মামা বলেন, ‘‘আমাদের ছেলেকে সামনে রেখে যাঁরা এত দিন প্রচারের আলো পেয়েছে, তাঁরাই এই নোংরামোটা করলেন। প্রত্যেককে চিনি, প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেব।’’ গত কালের স্মৃতি মনে করতে গিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠছেন মৃত পড়ুয়ার মা। আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বেশ কয়েক বার জ্ঞান হারান তিনি। জ্ঞান ফিরতে মায়ের প্রতিক্রিয়া, ‘‘সে দিন বাবুর উপরে কী অত্যাচার হয়েছিল, আমি হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। আমাকেও তো মেরে ফেলা হতে পারে। নিরাপত্তার অভাব বোধ করছি।’’

ঘটনার তীব্র নিন্দা করছেন স্থানীয় মানুষের একটি অংশ। শিক্ষক রানাপ্রসাদ চক্রবর্তী জানান, ‘‘যে মা সদ্য সন্তান হারিয়েছেন, তাঁকে লক্ষ্য করে এ ধরনের আচরণ শুধু অন্যায় নয়, অপরাধ। তীব্র ধিক্কার ও নিন্দা জানাই।’’ মূলত যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সেই সংগঠনের সদস্য পেশায় গৃহশিক্ষক নবেন্দু অধিকারী বলেন, ‘‘স্থানীয় মানুষ আবেগতাড়িত হয়ে কিছু করে ফেলেছে। মহকুমাশাসকের সঙ্গে আলোচনা করে একটা রফাসূত্র বেরিয়েছে। আশা করছি আর সমস্যা হবে না।’’ হাসপাতালের সুপার বীরেন মজুমদার বলেন, ‘‘ঘটনাটি নিজের চোখের সামনে ঘটতে দেখেছি। আবেগের বহিঃপ্রকাশ এ ভাবে না হলেই ভাল হত। ওর মায়ের প্রতি আমাদের সমবেদনা।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy