সিঁদুরে মেঘ দেখছে কল্যাণী!
অনুষ্ঠান বাড়িতে ঢুকে তোলা আদায়ে বাধা পেয়ে গুলি ছোড়া, এলাকার লোকজনকে শাসিয়ে সরকারি জমির মাটি কেটে বিক্রি করার মতো ঘটনার পরে কল্যাণীর মনে পড়ে যাচ্ছে পুরনো দিনের কথা। শহরের আনাচকানাচে প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে—কল্যাণী কি তাহলে ফের দুষ্কৃতীদের মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠছে?
স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, দুয়ারে নির্বাচন। একদিকে জোটের হাওয়া, অন্য দিকে তৃণমূলের জমি ধরে রাখার তাগিদ— শহরে ভোটের হাওয়া এমনিতেই গরম। তার উপরে দুষ্কৃতীদের এই তাণ্ডব মোটেই ভাল ঠেকছে না। প্রশ্ন উঠছে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও।
সম্প্রতি কল্যাণীর বেশ কয়েকটি ঘটনায় উত্তেজিত জনতা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ। শহরের বাসিন্দাদের প্রশ্ন, জনতাকে কেন আইন হাতে তুলে নিতে হচ্ছে? সমাজবিরোধীদের তাড়া করার সময়ে মাঝেরচর এবং বিদ্যাসাগর কলোনি এলাকাতে ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা প্রথমে পুলিশকে ঢুকতে দেয়নি। শহরের প্রবীণ বাসিন্দাদের একাংশ জানাচ্ছেন, এই ইঙ্গিত কিন্তু ভাল নয়। পুলিশের প্রতি মানুষের ভরসা হারালে এমনটাই হয়। দুষ্কৃতী দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে পুলিশ কড়া পদক্ষেপ না করলে এর ফল আরও মারাত্মক হবে।
গত কয়েক মাসে কল্যাণীর মাঝের চর এলাকায় মাটি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন এলাকার বাসিন্দারা। সরকারি জমির মাটি কেটে অবাধে বিক্রি করে দিচ্ছিল মাফিয়ারা। অভিযোগ, ওই মাফিয়াদের পাণ্ডা দেবু দাশ তৃণমূলের ছত্রছায়াতেই ছিল। তার দাপট এতটাই বেড়েছিল যে, মাঝে মাঝে সে দলের নেতৃত্বকেই চ্যালেঞ্জ করে বসছিল। কিন্তু তারপরেও দলের নেতারা তার বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করতে পারছিলেন না। কারণ, এলাকার প্রতিবাদী লোকজনকে চমকে কাজ হাসিল করাতে দেবু ছিল ওস্তাদ।
তৃণমূল সূত্রে খবর, সম্প্রতি দেবু ও তার দলবল আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে এলাকার প্রতিবাদী বাসিন্দাদের প্রাণনাশের হুমকি দিতে শুরু করে। সংবাদপত্রে সেই খবর প্রকাশের পর নেতারা তাকে কিছুদিন চুপচাপ থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই নির্দেশ না মেনে সে নেতাদেরই পাল্টা হুমকি দিয়ে বসে। দিন কয়েক আগে এলাকার বাসিন্দারা দেবু ও তার সঙ্গীদের তাড়া করে। তারা পালিয়ে গেলে দেবুদের দু’টি ডেরা ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয় উত্তেজিত জনতা। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ গেলে তাদের এলাকায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ সে দিন সাফ জানিয়েছিলেন, পুলিশ এতদিন কোথায় ছিল! সেই দেবুকে এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। জেলা পুলিশের এক কর্তার দাবি, এর আগেও বেশ কয়েকটি অভিযোগে দেবুকে ধরা হয়েছিল। কিন্তু প্রতি বারই সে ছাড়া পেয়ে গিয়েছে। এই ঘটনার পরে দেবু এলাকায় নেই। তার খোঁজে তল্লাশি চলছে।
এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে ফের দুষ্কৃতীরা তাণ্ডব চালিয়েছিল ঝিলপাড় কলোনিতে। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে ওই এলাকায় অনুষ্ঠান বাড়িতে চড়াও হয়েছিল জনা তিনেক দুষ্কৃতী। কল্যাণীর ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের ঝিলপাড়ায় হইচই শুনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন তৃণমূলের ওয়ার্ড কমিটির সদস্য মিন্টু তপাদার। বাধা দিতে গেলে ওই দুষ্কৃতীরা মিন্টুবাবুর হাত লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। গুরুতর জখম অবস্থায় কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তাঁকে।
অভিযোগ, ওই ঘটনার প্রতিবাদে পরের দিন বিদ্যাসাগর কলোনির মূল অভিযুক্ত সুমন মণ্ডলের বাড়িতে চড়াও হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ। সুমনকে না পেয়ে তার মা ও ভাইকে ব্যাপক মারধর করা হয়। ওই ঘটনার সময়েও পুলিশকে এলাকায় ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, সুমন ও দেবুদের মতো অনেকেই এলাকা দাপিয়ে বেড়ায়। রাজনীতির কারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় পুলিশ সব জেনেও তাদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করে না। আর সেই কারণেই পুলিশের উপর থেকে মানুষের ভরসা ক্রমশ হারাচ্ছে। কাদের প্রশ্রয়ে দুষ্কৃতীদের এমন বাড়বাড়ন্ত তা নিয়েও শুরু হয়েছে রাজনৈতিক চাপানউতোর।
সিপিএমের জেলা সম্পাদক সুমিত দে-র অভিযোগ, ‘‘তৃণমূলের প্রশ্রয়েই সমাজবিরোধীদের এত বাড়বাড়ন্ত। মুখে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও পুলিশকে বলছে কোনও পদক্ষেপ না করতে। ভোটে তো ওই দুষ্কৃতীরাই তৃণমূলের হয়ে কাজ করবে।’’ অভিযোগ উড়িয়ে তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত বলেন, ‘‘সমাজবিরোধী কার্যকলাপ কিছুতেই বরদাস্ত করা হবে না। পুলিশকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। তারা নিশ্চয় দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার করবে।’’
নদিয়ার পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পুলিশ কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে নেই। অভিযুক্তদের খোঁজে তল্লাশি চলছে। ওরা ধরা পড়বেই। আর শহরের অন্য এলাকা থেকে এ ব্যাপারে অভিযোগ পেলে নিশ্চয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy