তখন গণনা প্রায় মাঝপথে।
কৃষ্ণনগর কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থীর কাছে খবর এল, মাত্র তিন রাউন্ড গণনা শেষে কৃষ্ণনগর পুর এলাকা থেকে পনেরো হাজার ভোটে পিছিয়ে আছেন তিনি। প্রার্থী মহুয়া মৈত্র ফোন করলেন কৃষ্ণনগরের প্রাক্তন পুরপ্রধান অসীম সাহাকে, “আপনার পুর এলাকা থেকে আমরা তিন রাউন্ডেই পনেরো হাজার ভোটে পিছিয়ে আছি। এটা জানানোর জন্য ফোনটা করছি।”
সময় যত এগিয়েছে, তত বেড়েছে ব্যবধান। গণনা শেষে দাঁড়ায় প্রায় ২৭ হাজারে। কৃষ্ণনগরের ২৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে এক মাত্র ১৮ নম্বর ওয়ার্ড ছাড়া বাকি প্রত্যেকটিতে ভরাডুবি হয়েছে তৃণমূলের। অসীম সাহার ওয়ার্ডে প্রায় দেড় হাজার ভোটে পিছিয়ে থেকেছেন তৃণমূল প্রার্থী। তদানীন্তন জেলা তৃণমূল সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্তের ছেলে অয়ন দত্তের ২২ নম্বর ওয়ার্ডে হারতে হয়েছে ৬১ ভোটে।
লোকসভা ভোটে কৃষ্ণনগর শহরে তৃণমূলের পিছিয়ে থাকা নতুন নয়। গত নির্বাচনেও বিজেপি প্রার্থী সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় প্রায় ১৭ হাজার ভোটে এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু এ বার যে তার চেয়েও খারাপ অবস্থা হবে, তা সম্ভবত তৃণমূলের নেতানেত্রীরা বুঝে উঠতে পারেননি। কেননা অনেকেরই ধারণা ছিল, লোকসভা ভোটে সত্যব্রত ওরফে জলুবাবুর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিই এই শহর থেকে বিজেপির বাক্সে ভোট টেনেছে। অন্য নির্বাচনে তা আবার ‘যথাপূর্বং’ সামান্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বার আর জলুবাবু দাঁড়াননি। তৃণমূল তুমুল প্রচারও চালিয়েছিল।
তার পরেও এই বিপর্যয় কেন?
অসীম-বিরোধী পক্ষ তাঁকেই কাঠগড়ায় তুলছেন। তাঁদের দাবি, বহু মানুষ আসলে পুরসভার নানা অনিয়ম ও একশ্রেণির নেতাকর্মীর ফুলে-ফেঁপে ওঠার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। ভোটের কয়েক দিন আগে পুরপ্রধানের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ তুলে লিফলেট বিলিও করা হয়েছিল। পুরবাসীর একটা বড় অংশ যে প্রবল বিরক্ত, তা তৃণমূল নেতাদের অনেকেরই অজানা ছিল না। কিন্তু তা যে বিজেপিকে এতটা ‘লিড’ দেবে, তা তাঁরা আন্দাজ করতে পারেননি। কিন্তু আরও বড় বিপদের কথা হল, সামনেই কৃষ্ণনগর পুরসভা ভোট। বিজেপির দাবি, তৃণমূলের কিছু কাউন্সিলর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। মঙ্গলবার সাংবাদিক বৈঠক করে বিজেপির উত্তর সাংগঠনিক জেলা সভাপতি মহাদেব সরকার দাবি করেন, “তৃণমূল পরিচালিত কৃষ্ণনগর পুরসভার দুর্নীতি ও অনিয়ম মানুষের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। তাঁরা আমাদের ঢেলে ভোট দিয়েছেন। এ বার পুরসভাও আমরাই দখল করব।”
পুরপ্রধান ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গেরা অবশ্য তা মানতে নারাজ। অসীমের দাবি, “এ বার পুরোপুরি সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ভিত্তিতে ভোট হয়েছে। সেই কারণেই এই ফল। এক মাত্র ১৮ নম্বর ওয়ার্ডেই কি মানুষের পুরসভার বিরুদ্ধে ক্ষোভ নেই? তা কিন্তু নয়। ওখানে সংখ্যালঘুরা দলে ভারী, তাঁরা আমাদের ভোট দিয়েছেন।” ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের প্রাক্তন তৃণমূল কাউন্সিলর অনুপম বিশ্বাস আবার দাবি করেন, “আমার ওয়ার্ডে হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিস্টধর্মের মানুষের সংখ্যা প্রায় সমান। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে এই ওয়ার্ড থেকে লিড দিয়েছিলাম। কিন্তু ১৬টি ওয়ার্ডে পরাজিত হয়েছিল তৃণমূল। সে বার তো আর ধর্মের ভিত্তিতে ভোট হয়নি!”
বস্তুত, কৃষ্ণনগরের শোচনীয় ফল সামনে আসতেই তৃণমূলের অন্দরে শুরু হয়েছে চাপানউতোর। চলছে দায় এড়ানোর খেলাও। ক্ষোভের ফাটল মেরামত করে আরও বড় ধস তৃণমূল এড়াতে পারবে তো?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy